যৌবনে দাও রাজটিকা’ অবলম্বনে দেহের যৌবন ও মনের যৌবনের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে প্রমথ চৌধুরীর মূলবক্তব্য বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধানুসরণে দেহের যৌবন ও মনের যৌবনের পার্থক্য নির্ণয় কর।
উত্তর ভূমিকা :
প্রাণবন্ত তারুণ্যের সাধনাকে যিনি যথার্থ সাহিত্য সাধনা বলে ভেবেছিলেন এবং প্রয়োজনে বাঙালি পাঠককে যিনি অপ্রিয় সত্যভাষণে জর্জরিত করেছেন তিনি প্রমথ চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যের ঝরাকুঞ্জে তিনি ‘সবুজপত্রে’র সুবাতাস। বুদ্ধি, বিক্রম, উইট, হিউমার আর্ট ও নলেজ সবই ছিল তাঁর করায়ত্ত। সংস্কারের অন্ধতা থেকে মুক্তির প্রয়াস তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রমথ চৌধুরীর নবীনত্বে, বিদ্রোহত্বে, অগ্রযাত্রায় মানসিক যৌবন-চর্চারই আবাহন। এ প্রবন্ধে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে যৌবনের গুণকীর্তন করেছেন। মাসিক ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যৌবনকে রাজটিকা দেওয়ার প্রস্তাব প্রসঙ্গে জনৈক টীকাকারের ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে প্রাবন্ধিক এ প্রবন্ধের অবতারণা করেছেন।
যৌবনের স্বরূপ : মানবজীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তিই যৌবন। যৌবনে মানুষের বাহ্যেপ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরেন্দ্রিয় সজাগ ও সবল হয়ে উঠে এবং সৃষ্টির মূলে যে প্রেরণা আছে, মানুষ সে প্রেরণা তার সকল আঙ্গ, সকল মনে অনুভব করে। অর্থাৎ যৌবনে মানুষের দেহ ও মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। যৌবন এমন একটি শক্তি যা মানুষকে সজাগ ও সবল করে তোলে। দেহের যৌবনই প্রকৃত যৌবন নয়, মনের যৌবনই, প্রকৃত যৌবন। প্রাবন্ধিক এ প্রবঙ্গে দেহের যৌবন ও মনের যৌবনের পার্থক্য নির্দেশ করে তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন।
দেহের যৌবন : মানুষের জীবনকে শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য এই চারভাগে ভাগ করা যায়। এ বিভাজন দৈহিত বৃদ্ধি ও বয়সের মাপকাঠিতে বিচার্য। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে এবং কৈশোর পেরিয়ে মানুষ যৌবনে পদার্পণ করে। এ সময় দেহের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে। কৈশোরের চাঞ্চল্য খসে পড়ে দেহ থেকে। আর যৌবনের উন্মাদনা সন্ত্রাগ করে তোলে দেহকে। যৌবনে সন্ধ পৃথিবীটাকে রঙিন বলে মনে হয়। তবে দেহের এ যৌবন ক্ষণস্থায়ী। স্বাস্থ্য ও চেহারার চাকচিক্য যতদিন স্থায়ী হয় দৈহিক যৌবনও ততদিন টিকে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে দেহের যৌবন ও চাকচিক্য ফিকে হয়ে আসে। বয়সের পূর্ণতায় এর বিকাশ আর বয়সের আধিক্যে এর অবসান।
মনের যৌবন : দেহের যৌবন আর মনের যৌবন এক নয়। দেহের যৌবন ক্ষণস্থায়ী কিন্তু মনের যৌবন চিরস্থায়ী। মনের যৌবনকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। প্রকৃতপক্ষে মনের যৌবনই প্রকৃত যৌবন। বয়স কম বা বেশি এ বিচারে মানসিক যৌবনের স্বরূপ বিবেচ্য নয়। মনের যৌবন সমাজকে সজীব, সচল ও সজাগ করতে পারে। পুরাতনকে আঁকড়ে থাকাই বার্ধক্য অর্থাৎ জড়তা। মানসিক যৌবন লাভের জন্য প্রথম আবশ্যক প্রাণশক্তি। প্রাণের স্বাভাবিক গতি হচ্ছে মনোজগতের দিকে; প্রাণের স্বাধীন স্ফূর্তিতে বাধা দিলেই তা জড়তাপ্রাপ্ত হয়। মনের যৌবনের প্রধান উপকরণই হচ্ছে এই প্রাণপ্রাচুর্য। প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেলে মনের যৌবনও শুকিয়ে যায়।
দেহের যৌবন ও মনের যৌবনের পার্থক্য : দেহের যৌবন ও মনের যৌবনের পার্থক্য সম্পর্কে প্রাবন্ধিক বলেছেন, “দেহ ও মনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের উপর মানবজীবন প্রতিষ্ঠিত হলেও দেহ-মনের পার্থক্যের উপরই আমাদের চিন্তারাজ্য প্রতিষ্ঠিত। দেহের যৌবনের সাথে মনের যৌবনের একটা যোগাযোগ থাকলেও দৈহিক যৌবন ও মানসিক যৌবন স্বতন্ত্র। এ মানসিক যৌবন লাভ করতে পারলেই আমরা তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারব। দেহ সংকীর্ণ ও পরিচ্ছন্ন; মন উদার ও ব্যাপক। একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেবার জো নেই; কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সংক্রমণ করে দেওয়া যেতে পারে।
বিশ্লেষণ : দেহ ও মন পরস্পর নির্ভরশীল হলেও দেহের উপর মনের প্রভাব অত্যধিক। সমাজকে সজাগ, সচল ও সজীব করতে হলে মনের যৌবন আবশ্যক। সমাজে নতুন মন ও নতুন প্রাণের নিত্য জন্ম লাভ একান্ত প্রয়োজন। যে যৌবন সমাজে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করে সে মানসিক যৌবনকে রাজটিকা পরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন প্রমথ চৌধুরী। দেহের যৌবনের স্থায়িত্ব যেহেতু কম ও সীমিত, সেহেতু মনের চিরস্থায়ী যৌবনের পরিচর্যা করাই এ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য। মনের যৌবন হারিয়ে গেলে সমাজ বার্ধক্যের কবলে পড়ে নির্জীব ও অচল হয়ে পড়বে।
যৌবন বন্দনার স্বরূপ : যৌবন মানবজীবনের উৎকৃষ্ট সময়, কিন্তু যৌবনকে বয়সের মাপকাঠিতে বিচার করা ঠিক নয়। মনের যৌবনই প্রকৃত যৌবন। যার মনে যৌবন নেই তার দৈহিক যৌবন মূল্যহীন। দেহের যৌবন এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তর করা যায় না; কিন্তু এক মনের যৌবন অন্য মনে সঞ্চালন করা সম্ভব। সমাজদেহে এ মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠা করা একান্ত আবশ্যক। ব্যক্তিগত জীবন থেকে ফাল্গুন একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না; কিন্তু সমগ্র সমাজে ফাল্গুন চিরদিন বিরাজ করে। আমরা সমগ্র সমাজকে একটি ব্যক্তি হিসেবে দেখলেও আসলে মানবসমাজ হচ্ছে বহুব্যক্তির সমষ্টি। যে সমাজে বহু ব্যক্তির মানসিক যৌবন আছে, সে সমাজেরই যৌবন আছে। বার্ধক্য কিছু অর্জন করতে পারে না বলে কিছু বর্জনও করতে পারে না। কিন্তু যৌবন অর্জন ও বর্জন দুই-ই করতে পারে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, দেহের যৌবন ও মনের যৌবনের মধ্যে পার্থক্য বিরাট। দেহের যৌবন ক্ষণস্থায়ী আর মনের যৌবন চিরস্থায়ী। একের দেহের যৌবন অন্যের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একের মনের যৌবন অন্যের মনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া সম্ভব। সুতরাং মনের যে যৌবন সমাজের প্রাণশক্তি, সে যৌবনের কপালে রাজটিকা পরিয়ে দেওয়া আমাদের সকলেরই কর্তব্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%af%e0%a7%8c%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%9f%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%aa/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*