মার্কসীয় ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।

অথবা, মার্কসীয় নারীবাদ ও সমাজতান্ত্রিক নারীদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য দেখাও।
অথবা, মার্কসীয় ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ কর।
অথবা, সমাজতান্ত্রিক ও মার্কসীয় নারীবাদের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? লিখ।
অথবা, মার্কসীয় নারীবাদ ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যসমূহ তুলে ধর।
অথবা, মার্কসীয় নারীবাদ ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের মধ্যেকার বৈসাদৃশ্যসমূহ মূল্যায়ন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
নারীবাদ প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধঃস্তনতা দূর করে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে প্রয়াসী। অপরদিকে মার্ক্সবাদ সকল প্রকার শ্রেণিশোষণ বিলোপ করে একটি শ্রেণিহীন ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। সুতরাং উদ্দেশ্যের দিক থেকে এ উভয় দার্শনিক আন্দোলনই বৈষম্যমূলক সমাজ বিলোপ করে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার এক নিরস্তর আন্দোলন। মার্কসীয় ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের মধ্যে পার্থক্য : নারীবাদ ও মার্ক্সবাদের মধ্যে যেসব পার্থক্য রয়েছে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. মার্ক্সবাদীরা নারীমুক্তিকে সর্বদাই মানবমুক্তির তথা নারী ও পুরুষ উভয়ের মুক্তির অংশ হিসেবে মনে করেন। কিন্তু আধুনিক নারীবাদীরা নারীমুক্তিকে পুরুষের প্রভুত্ব থেকে নারীর মুক্তি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত এবং তাই সর্বদাই তারা নারীমুক্তিকে একটি স্বাধীন ও ‘অটোনোমাস’ আন্দোলন হিসেবে দেখতে চান। ফলে মার্ক্সবাদের মানবমুক্তির সর্বজনীন এজেন্ডাকে নারীবাদীরা অসম্পূর্ণ সুভাওতা বলে মনে করেন এবং সমাজ শোষণ বিলুপ্ত হলেই, শ্রেণি বিলুপ্ত হলেই, নারীরা মুক্তি পারে-এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় নারীমুক্তির তত্ত্বে তারা বিশ্বাস না। বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন ক্ষেত্রের শোষণ উচ্ছেদকেই পারিবারিক ক্ষেত্রে শোষণ উচ্ছেদের সমার্থক বলে চালিয়ে দেয়ার অতি উৎসাহী মার্ক্সবাদী প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। এদিক থেকেও নারীবাদের সঙ্গে মার্ক্সবাদের একটু মতপার্থক্য বিদ্যমান। তবে একথা সত্য যে মার্ক্সবাদীরা সকল ধরনের শোষণ ও ক্ষমতা বৈষম্যের চূড়ান্ত অবসান চান। প্রথমে অবশ্য তারা গুরুত্ব দিতে চান শ্রমের সামাজিক উৎপাদন জগতে শোষণের অবসান এবং পরে যা একই সঙ্গে পরিপূরক সংগ্রাম হিসেবে ‘শ্রমের পুনরুৎপাদন ক্ষেত্রেও তারা শোষণমূলক অসম সম্পর্কের অবসান ঘটাতে চান। তবে কোনো অবস্থাতেই মার্ক্সবাদীরা নারীকে একান্তভাবে গৃহশ্রমে আবদ্ধ রাখতে চান না। মার্ক্সবাদীদের গৃহশ্রম ও সামাজিক শ্রম এই দুই ক্ষেত্রের গুরুত্বের হেরফেরটা Radical Feminist-রা সম্ভবত পছন্দ করেন না। তারা তাদের পারিবারিক এজেন্ডাকেই প্রধান এজেন্ডা হিসেবে সামনে আনতে চান। এটাই
সম্ভবত Radical Feminist দের সঙ্গে মার্ক্সবাদীদের বিরোধের মূল কারণ। এক্ষেত্রে দুই-এর মধ্যে ‘Unholly Marriage’ নয়। বরং একটি ‘holly compromise’ হতে পারে বলেই আমরা মনে করি। উভয় গোষ্ঠী যদি নিজ নিজ গোঁড়ামি বাদ দিয়ে স্বীকার করে নেন যে, সাধারণভাবে সামাজিক বৈষম্য নিরসনের সংগ্রাম এবং পারিবারিক বৈষম্য নিরসনের সংগ্রাম উভয়ই হচ্ছে পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক এবং উভয় সংগ্রামের সম্মিলিতভাবে অগ্রসর করতে পারলেই আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে পারবো। কার্ল মার্ক্স তার ক্যাপিট্যালের প্রথম ভলিউমে প্রথমে মনের শ্রমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেটা নারীর না পুরুষের; এই প্রশ্নকে তিনি প্রাসঙ্গিক মনে করেননি। সুগভীর বিশ্লেষণের সাহায্যে মার্ক্স উপনীত হয়েছে শ্রম শক্তি’ ‘বিমূর্ত শ্রম’ ‘সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম সময়’ ‘উদ্ধত্ত শ্রম সময়’ ইত্যাদি নানাবিধ প্রত্যয়ে। এরপরে এসেছে শ্রমশক্তির মূল্য; উদ্ধত্তমূল্য এবং শ্রমের দাস বা মজুরির প্রশ্ন। মার্ক্সের এসকল ধারণার সঙ্গেও নারীবাদীদের দৃষ্টি ভঙ্গির পার্থক্য বিদ্যমান।
৫. বুর্জোয়া নারীবাদীরা যেমন একদিকে পারিবারিক শ্রমের মূল্যায়নের নামে গৃহের ভেতরে পণ্য সম্পর্ক চালু করার দাবি করেন এবং স্বামীকে পুঁজিবাদী এবং স্ত্রীকে সর্বহারা বানিয়ে গৃহের অভ্যন্তরে শ্রেণি সংগ্রামের
আহ্বান জানান। সে রকমটি মার্ক্সবাদীরা মোটেও দাবি করেন না। মার্ক্সবাদীরা একমাত্র বাধ্যতামূলক বা কাঠামোগত বা আরোপিত অসম পারিবারিক সম্পর্কগুলোরই অবসান চান
৬. মার্ক্সবাদ বলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে সব শোষণ পীড়নের উদ্ভব। সুতরাং এই সম্পত্তি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করলেই নারী নিপীড়নও শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনে তার প্রমাণ পাওয়া যায়, নি। যে কারণে আধুনিক নারীবাদী তাত্ত্বিকরা সম্পত্তির উচ্ছেদ নয়, বরং সম্পত্তিতে নারীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতেই বেশি বদ্ধপরিকর।অর্থনীতিবিদ হেইডি হাটম্যান তাঁর ‘দ্যা আনহ্যাপি ম্যারেজ অব মার্কসিজম অ্যান্ড ফেমিনিজম: টুয়ার্ডস-এ মোর প্রোগ্রেসিভ ইউনিয়ন’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, “প্রাথমিক পর্যায়ে মার্ক্সবাদীরা নারীর শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকলেও তারা পুঁজিবাদের অধীনে পুরুষ ও নারীর ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন নি। তারা নারীবাদী এই প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করে না যে, কেন এবং কিভাবে নারী হিসেবে নিপীড়িত হন, তাই তারা নারীর অব্যাহত অধস্তনতায় পুরুষের স্বার্থ স্বীকার করেন না।
৮. নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের উপর বেশি জোর দেয়ার পদোন্নতি। কিন্তু মার্ক্সবাদী বিশ্লেষকরা পুরুষতন্ত্রকে ওতটা গুরুত্ব প্রদান করেন না। নারীবাদীরা মনে করেন পুরুষতন্ত্রের বস্তুগত ভিত্তি আছে যার মধ্য দিয়ে পুরুষরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নারীর ওপর নিপীড়ন চালায়।
৯. লিভিয়া সার্জেন্ট সম্পাদিত ‘ওম্যান অ্যান্ড রেডুলিউশনের এ ডিসকাশন অব দ্য আনহ্যাপি ম্যারেজ অব মার্কসিজম অ্যান্ড ফেমিনিজম’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ আছে উনিশ শতকে নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে মার্ক্স
এঙ্গেলসের যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকলেও তারা তাতে যুক্ত হয়নি। নারী অধিকারের সঙ্গে তাঁরা সমাজতন্ত্রের খুব যোগাযোগ খুঁজে পাননি। মার্ক্স পুঁজিবাদ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার যে নিয়ম, প্রবণতা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়৷
উল্লেখ করেছেন, তাতেও যে নারীবাদীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন তা বুঝা যায় শ্রমশক্তিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও নারীর গৃহকাজের মূল্য সম্পর্কে আলোচনায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য এখনো পর্যন্ত সবচাইতে শক্তিশালী মতাদর্শিক দিকনির্দেশনা মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি থেকেই পাওয়া যায় এবং দেশে দেশে বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ ও শ্রেণি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবচাইতে কার্যকর জোরালো কণ্ঠ মার্ক্সবাদীদেরই। বিদ্যমান সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন যারাই অনুভব করেছে বা করেন, তাদেরই তাই মতাদর্শ হিসেবে মার্ক্সবাদকে হিসাবের মধ্যে আনতে হয়। সে কারণে নারীমুক্তি আন্দোলন বা নারীবাদ তা যে আকারেই হোক শেষ পর্যন্ত মার্ক্সবাদকে উপেক্ষা করতে পারে না।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%90%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%93/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*