নারীবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে সম্পর্ক দেখাও।

অথবা, নারীবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে যেসব সাদৃশ্য রয়েছে তা বর্ণনা কর।
অথবা, নারীবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে কি কোন সম্পর্ক রয়েছে? লিখ।
অথবা, নারীবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে সম্পর্কসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, মার্কসবাদ ও নারীবাদের মধ্যে সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্যসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, মার্কসবাদ ও নারীবাদের মধ্যে সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্যসমূহের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
নারীবাদ হলো পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজে নারীর উপর শোষণ নিপীড়ন সম্বন্ধে সচেতনতা অর্জন এবং এই অবস্থা পরিবর্তনে নারী ও পুরুষের সচেতন সক্রিয় উদ্যোগ। নারীবাদ কেবল সমতা ও মুক্তির সংগ্রাম নয় বরং তার বিরুদ্ধে সকল শোষণের অবসানের লক্ষ্যে সমান অধিকার ও আইনি সংস্কারের উদ্যোগ।
নারীবাদ : নারীবাদ বা Feminism’ কথাটি ১৮৮০ এর দশকে ফরাসি শব্দ Femine থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে যার অর্থ Women/নারী এই শব্দটির সাথে ism বা বাদ কথাটি যুক্ত হয়ে Feminism/নারীবাদে পরিণত হয়েছে। Feminism’ কথাটি দ্বারা বুঝানো হতো ঐসব ব্যক্তিকে যারা নারী পক্ষের পক্ষাবলম্বন করে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ফরাসি সমাজতন্ত্রী চার্লস ফুরিয়ের সর্বপ্রথম ‘Feminism’ কথাটি ব্যবহার করেন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সাধারণভাবে নারীবাদ হচ্ছে এমন এক তত্ত্ব যা নারী সমাজের উপর পুরুষের নিপীড়ন, এর কারণ ও ফলাফল এবং নারীমুক্তির কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ দেয়। নিম্নে কয়ে জন নারীবাদী সংজ্ঞা প্রদান করা Rosalind Delmar বলেন, “নারীবাদ মূলত সমাজে নারীর অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় আগ্রহ।” প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ও বাংলাদেশের অন্যতম নারী চিন্তাবিদ সালমা খান বলেন, “নারীবাদ হলো নারী পুরুষের সমন্বয়ে একটি ন্যায়বিচার ভিত্তিক সুষম ও উন্নত সমাজ সৃষ্টির প্রক্রিয়া মাত্র।”
মাকর্সবাদ (Marxism) : কার্ল মার্ক্সের নামে পরিচিত হলেও মার্ক্সবাদ মার্ক্স ও এঙ্গেলস এর যৌথ সৃষ্টি। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় খুঁটিনাটি বিচার করে মার্ক্স ও এঙ্গেলস একযোগে ঊনবিংশ শতাব্দির মধ্য ও শেষভাগে সমাজ সম্বন্ধে যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন সেটিই হলো মার্ক্সবাদ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন ভাবে মার্ক্সবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :
লেনিনের ভাষায়, “মার্ক্সের কিছু মতামত ও শিক্ষাই হলো মার্ক্সবাদ।” প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক প্লেখনেক এর মতে, “মার্ক্সবাদ হলো একটি অখণ্ড বিশ্ববীক্ষা।” এমিল বার্নস বলেছেন, “মার্ক্সবাদ হলো আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ মানব সমাজ সম্বন্ধে সাধারণ তত্ত্ব।” সুতরাং বলা যায়, কার্ল মার্ক্স একটি শ্রেণিহীন শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়ে তুলবার জন্য তার যাপিত জীবনে যে ধারণা ও তত্ত্বের অবতারণা করে তার সমষ্টিগত রূপকেই মার্ক্সবাদ বলে।
নারীবাদ ও মার্ক্সবাদের সম্পর্ক : নারীবাদ ও মার্ক্সবাদ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। উভয়েই উদ্দেশ্য বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা বিলোপ করে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। নারীবাদ ও মার্ক্সবাদ এর মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই বিদ্যমান। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
সাদৃশ্য : নারীবাদ ও মার্ক্সবাদের মধ্যে যে সব সাদৃশ্য বিদ্যমান তা হলো :
উভয় মতাবাদই শ্রেণিহীন ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে। উভয় আন্দোলনই মনে করে শোষণই বৈষম্যের জন্মদাত্রী। নারীবাদ নারীপুরুষ বৈষম্য দূর করে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে চায় অপরাধিকে মার্ক্সবাদ ও পুঁজিবাদী মুনাফা কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে একটি কল্যাণমূলক সমাজ গঠন করতে চায় । উভয় মতবাদই সম্পদের সুষম বন্টনের পক্ষে বিশ্বাস উভয় মতবাদই মনে করে সমাজে যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বিরাজমান তা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়নি পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজই নিজেদের স্বার্থে এ বৈষম্য গড়ে তুলেছে।
নারীবাদ নারী-পুরুষকে সমান চোখে দেখার একটি আন্দোলন ঠিক তেমনি মার্ক্সবাদে ও নারী-পুরুষে কোনো পার্থক্য তৈরি করা হয় না। নারী বলেই তারা দুর্বল ও শোষিত একথা মার্ক্সবাদীরা মানতে নারাজ। নারীবাদীরাও ঠিক তেমনি একথাই বলেন। মার্ক্সবাদের মূল মর্মবাণী ‘শোষণহীন সমাজ’/শ্রম বিভাগমুক্ত শ্রেণিহীন, রাষ্ট্রহীন, সাম্যবাদী সমাজের সঙ্গ নারীবাদের কোনো বিরোধ নেই। মার্ক্স ও এঙ্গেলস উভয় পুঁজিবাদকে নারী নিপীড়নের মূল বলেছেন। নারীবাদীরাও তেমনটি বলে থাকেন। মার্ক্সবাদ ও নারীবাদ উভয় মতবাদীরা সমাজ বিকাশের ধারায় মানুষের ‘মানবিক’ গুণগুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
বৈসাদৃশ্য : মার্ক্সবাদ ও নারীবাদের মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো :
মার্ক্সবাদীরা নারীমুক্তিকে সর্বদা মানবমুক্তি তথা নারী ও পুরুষ উভয়ের যুক্তির অংশ হিসেবে দেখেন। কিন্ত

আধুনিক নারীবাদীরা নারীমুক্তিকে পুরুষের প্রভুত্ব থেকে নারীর মুক্তি হিসেবে দেখেন। বিদ্যমান সমাজতাত্ত্বিক সমাজে উৎপাদন ক্ষেত্রের শোষণ উচ্ছেদকেই পারিবারিক ক্ষেত্রে শোষণ উচ্ছেদের সমার্থক বলে চালিয়ে দেয়ায় অতি উৎসাহী মার্ক্সবাদী প্রোপাগাণ্ডা চালানো হয়। এদিক থেকেও নারীবাদীদের সাথে মার্ক্সবাদের একটু পার্থক্য বিদ্যমান। মার্ক্সবাদীদের গৃহশ্রম ও সামাজিক শ্রম এই দুই ক্ষেত্রের গুরুত্বের হেরফেরটা Radical Feministরা সম্ভবত পছন্দ করেন না। তারা তাদের পারিবারিক এজেন্ডাকেই প্রধান এজেন্ডা হিসেবে সামনে আনতে চান। এটাই
সম্ভবত Radical Feministদের সাথে মার্ক্সবাদীদের বিরোধের মূল কারণ। তারা উভয়েই যদি সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য নিরসনের সংগ্রামকে পরস্পরের পরিপূরক ভাবতেন তাহলে তা উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক হতে পারে। কার্ল মার্কস তার ক্যাপিটালের প্রথম ভলিউমে মনের শ্রমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেটা নারীর না পুরুষের এই প্রশ্নকে তিনি প্রাসঙ্গিক (Relevant) মনে করেননি। শ্রমশক্তি’ বিমূর্ত শ্রম’, দ্বৈত শ্রম সময়’, ‘শ্রমশক্তির মূল্য’, ‘উত্তমূল্য’ মার্ক্সের এ সকল ধারণার সঙ্গেও নারীবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বিদ্যমান । বুর্জোয়া নারীবাদীরা যেমন একদিকে পারিবারিক শ্রমের মূল্যায়নের নামে গৃহের ভেতরে পণ্য সম্পর্ক চালু করার দাবি করেন এবং স্বামীকে পুঁজিবাদী ও স্ত্রীকে সর্বহারা বানিয়ে গৃহের অভ্যন্তরে শ্রেণিসংগ্রামের আহ্বান জানান, সেরকমটি মার্ক্সবাদীরা মোটেও দাবি করেন না। মার্ক্সবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পদকে সব শোষণের মূল বলে মনে করেন। কিন্তু নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা সম্পদের উচ্ছেদ নয় বরং সম্পত্তিতে নারীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতেই বেশি বদ্ধপরিকর। নারীবাদ পুরুষতন্ত্রের উপর বেশি জোর দেয়ার পক্ষপাতি। কিন্তু মার্ক্সবাদী বিশ্লেষকরা পুরুষতন্ত্রকে ওতটা গুরুত্ব প্রদান করেন না।
মূল্যায়ন : মার্ক্সবাদ নারী প্রশ্নকে কিভাবে দেখে, নারীমুক্তি আন্দোলনকে মার্ক্সবাদ কতটা ধারণ করতে সক্ষম, মার্ক্সবাদ নির্দেশিত সাম্যবাদী সমাজে নারীর অবস্থান কী ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী মত ও বিতর্ক বিগত শতকের সত্তর-আশির দশকে ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকে। এই বিতর্কের মধ্য দিয়ে বহু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এই বির্তকের পক্ষে ও বিপক্ষে মতবাদ বিদ্যমান। কেউ বলেছেন মার্ক্সবাদ শ্রেণিসংগ্রামের উপর গুরুত্ব দেয়ায় নারীমুক্তি আন্দোলন উপেক্ষিত হয়। কেউ কেউ বলেন যে, ভ্যানগার্ড পার্টি যে আমলাতন্ত্রের জন্ম দেয় বা পুরুষতন্ত্রকে সহায়তা করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি থেকেই বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মতাদর্শও দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। দেশে দেশে বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ ও শ্রেণি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবচাইতে কার্যকর জোরালো কণ্ঠ মার্ক্সবাদীদেরই। বিদ্যমান সমাজ, অর্থনীতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন যারাই অনুভব করেছে তাদেরই মার্ক্সবাদের মতাদর্শকে হিসেবের মধ্যে মানতে হয়েছে। যে কারণে নারীবাদ/নারীমুক্তি আন্দোলন যে আকারেরই হোক শেষ পর্যন্ত মার্ক্সবাদকে উপেক্ষা করতে পারে না।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%90%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%93/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*