বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বরূপ আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা :
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের রয়েছে নিজস্ব গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের জনচরিত্রের সাধারণ প্রবণতা ও মনস্তাত্ত্বিক মাত্রাবোধের উপস্থিতি ঘটছে এর অব্যাহত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। আমাদের জনগণের হাজার বছরের লালিত মূল্যবোধ, বিশ্বাস, জীবনবোধ ও মুক্তিসংগ্রাম প্রতিফলিত হচ্ছে আমাদের রাজনীতির ভাষায়, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। বিগত শতাব্দীর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অনুসৃত বিধিব্যবস্থা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দিয়েছে একান্ত নিজস্ব স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য। এখানে বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি : আমাদের রাজনীতির ভাষা তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্নভাবে। উচ্চারিত শ্লোগান সন্নিবেশিত দেওয়ালে লিখন,
প্রকাশিত বিবৃতি প্রমাণ করছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো স্তরে আমাদের অবস্থান। রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোনো অদৃশ্য বিষয় নয়, আমাদের মন ও মনন, মানুষ ও মানস এতে বিবৃত। এসবের স্বরূপ সন্ধানেই বেরিয়ে আসবে রাজনীতির স্বচ্ছ চেহারা। নিচে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সংস্কৃতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করা হলো :
১. অস্থিরতা : মিছিল, মিটিং এ যখন উচ্চারিত হয় ‘একশন একশন ডাইরেক্ট একশন’ অথবা ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’ তখন এর মধ্য দিয়ে সামাজিক অস্থিরতাই প্রমাণিত হয়। এক দল আর এক দলের বিরুদ্ধে, ডানপন্থিরা বামপন্থিদের বিরুদ্ধে, সরকারি দল বিরোধী দলের বিরুদ্ধে, বিরোধী দল সরকারি দলের বিরুদ্ধে হরহামেশা এ একশনের
শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে।
2.শর্ত:সেখানে বাংলাদেশের Political culture এ ঠিক এ সময়ে বিরাজ করছে চরম অসহিষ্ণুতা। শ্লোগান, দেওয়ালে লিখন ও
বিবৃতি যেখানেই দৃষ্টি নিবন্ধ করা যায়, দেখা যাবে এক দল অপর দলকে কোনক্রমে সহ্য করতে পারছে না।
৩. অরাজকতা : অস্থিরতা এবং অসহিষ্ণুতা জন্ম দিচ্ছে এক অরাজক অবস্থার। মারামারি, লাঠালাঠি, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও, বোমাবাজি, গুলি, হত্যা এবং লুটতরাজ এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবশ্যিক উপকরণে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থার প্রতিফলন ঘটে মিছিলে, দেওয়ালে, বক্তৃতায়, এমনকি বিবৃতিতে।
৪. দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ : একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা Civic culture এ রাজনৈতিক দল গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে যে Working relation ধারা দরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তা অনুপস্থিত। রাজনৈতিক অঙ্গনে যেন পাঠালাঠি সংঘর্ষ একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
৫. ধর্ম : বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা বক্তব্যে ধর্ম আর একটি অনিবার্য বিষয়। রাজনৈতিক শ্লোগানে, দেওয়ালে লিখনে, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনৈতিক দলসমূহের পোস্টার ও লিফলেটে ধর্মের ব্যবহার ব্যাপকভাবে রিলক্ষিত হয় (প্রতীকী প্রত্যয়ের জন্য দ্রষ্টব্য, হোসেন ১৯৯২), তবে এর রকমফের রয়েছে।
৬. উত্তরাধিকারের রাজনীতি : সম্মোহনী নেতৃত্বের উত্তরাধিকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অপর একটি মৌল বিষয় ।
৭. জাতীয় ঐকমত্যের সংকট : গোটা জাতি যে জাতীয় ঐকমত্যের সঙ্কটে নিপতিত আমাদের রাজনীতির ভাষায় তা উচ্চকিত। জাতি পরিচয়, রাষ্ট্রীয় মৌল নীতিমালা, সরকারের ধরন, ধারণ এবং জাতীয় উন্নয়ন কৌশল নিয়ে বহমান বিতর্ক দেওয়াল শ্লোগানে বিধৃত। বাঙালি না বাংলাদেশি, ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা, ভারত বন্ধু না শত্রু, বাজার অর্থনীতি না নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি নাকি মিশ্র অর্থনীতি প্রভৃতি বিতর্কে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যেমন বিভোর ।
৮. ভাবাদর্শের সংঘাত : বাংলাদেশে একটি তীব্র ভাবাদর্শের সংঘাত চলছে। ‘৭৫ সাল এ ভাবধারার পালাবদলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা এবং ১৯৭২ সালের সংবিধান জাতিকে চারটি মূলনীতি প্রদান করে। এগুলো হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। ১৯৭৫ সালে বিশেষত জিয়াউর রহমান শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জিত হয়। ‘আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপিত হয়। সমাজতন্ত্র সময়ের বিবর্তনে আবেদন হারিয়ে ফেলে। ‘অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার অর্থে’ তা টিকে থাকে। জাতীয়তাবাদও নতুন বঞ্ছনা অর্জন করে । বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর বদলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তিত হয় ।
৯. মুক্তিযুদ্ধ : আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি বিরাট অংশ জুড়ে আছে। দওয়ালে লিখন, রাজপথের উচ্চারিত শ্লোগান অথবা নির্বাচনি বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ।
১০. নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি : বাংলাদেশি জনচরিত্র সম্পর্কে ‘নেতিবাচক’ দৃষ্টিভঙ্গির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। বিগত এক দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করলে একই প্রবণতা পরিদৃষ্ট হয়।
১২. ছাত্র সংগঠনের প্রাধান্য : বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রসমাজ একটি প্রবল শক্তি। ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয় ।
১৩. ক্রমশ বিকশিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি : চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র বিকাশমান। জাতি হিসেবে পুরনো হলেও গণতন্ত্রের পথে আমাদের অভিযাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে অভ্যুদয়ের পরেও পতন্ত্রের ‘ম্যারাথন রেসে’ আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক হার্ডলস। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের গণতন্ত্রের পথে নতুন করে পুরানো যাত্রা শুরু করতে হয়। ১৯৯০-২০০১ এ সময়কাল তন্ত্রকে আরও প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে সক্ষম হয়েছে এ সময়ে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি খণ্ডিত। এতে যেসব গতি প্রকৃতি (Trend and dency) রয়েছে দফাওয়ারি সে বিষয়গুলোও সংকটে নিপতিত। আর জাতীয় ঐকমত্যের সংকট এজন্যই সৃষ্টি হয়েছে যে,নাগরিক সাধারণের জন্য একটি অভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারি না। রাজনৈতিক দল শেষত স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক এলিট ক্ষমতাসীন ছিলেন তাঁরা নিজ নিজ দলীয় আদর্শ ও সূচি দ্বারাই দেশ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষাব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম ও সরকারি কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি কাঙ্ক্ষিত বোধের সংহতি (Values Integration) সবসময়ই উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে রাজনীতিতে সর্বজনস্বীকৃত বৈধতার সূত্র
egitimacy Formula) গড়ে উঠতে পারেনি।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*