বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, তুমি কি মনে কর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসনের সমস্যা বিদ্যমান?
অথবা, তুমি কি মনে কর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুপরিচালনের সমস্যা বিদ্যমান? যুক্তিসহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বাধাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়গুলো আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ‘
Governance’ বা সুশাসন বা সুপরিচালন শব্দটি সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মূলত রাষ্ট্রকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে উৎকর্ষের শীর্ষে পৌছে দেওয়াই ‘Governance’ এর প্রধান কর্তব্য। রাষ্ট্র নামক বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠনটি পরিচালনার জন্য দক্ষ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন, নীতিবান এবং হৃদয়বান ব্যবস্থাপকের গুরুত্ব অপরিহার্য। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় বিষয় সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই। কোনো গোষ্ঠীর উপর শাসন নামে কোনো প্রকার নিপীড়ন চালানো চলবে না এটাই
‘Governance’ বা সুশাসনের মূলকথা। সরকার যদি প্রকৃত জনগণের কাছে দায়িত্বশীল, দায়বদ্ধ, স্বচ্ছ ও কর্তব্যপরায়ণ থাকে তবেই ‘Governance’ কথাটি কার্যকর ও সাফল্য লাভ করবে। ‘Governance’ কথার মধ্যে শুধুমাত্র সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও কার্যাবলির কথাই নিহিত নেই সরকারের সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় গুণাবলির কথাও অন্তর্নিহিত রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশাসন বা সুপরিচালনার সমস্যা (Problems of good governance or good management in Bangladesh political system) : বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি পশ্চাৎপদ। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় পিছিয়ে। জনসংখ্যাধিক্য, অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের সমস্যায় অনুন্নত দেশ। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক জর্জরিত বাংলাদেশের যে কোনো সরকারের পক্ষেই সার্বিক সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব ব্যাপার। সরকার গঠনে জনগণের অংশগ্রহণ, সরকার গঠনের বৈধতা, সরকারের সমর্থনের বৈধতা, আইনের শাসন, সাংবিধানিকতা, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক, সরকার বদল ও বিরোধী ইত্যাদি বিচারবিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্রের সুপরিচালনা কার্য নির্ভর
করে। নিম্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুপরিচালন বা সুশাসনের সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলো :
১. দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসন (23 years long term Pakistani rule) : পাকিস্তান তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের অঙ্গ হিসেবে অবস্থানরত বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে। অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসনামল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেখানে শুধু সুপরিচালনার অভাবই নয়, সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের এবং সামরিক বেসামরিক আমলার নেপথ্য পরিচালনায় সরকার পরিচালিত হতো। সেখানে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করার প্রশ্ন আসে না। এরূপ পরিস্থিতিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিপূর্ণ গণতন্ত্রায়নের পথে পরিচালিত হতে চাইলে নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের নানা সমস্যার ফলে সরকার সুষ্ঠু গণতন্ত্র বিকাশে ও সুপরিচালনায় ব্যর্থ হয়।
২. আত্মবিকাশের পরিবেশ সৃষ্টির অভাব (Lack of creating self-developing environment) : পৃথিবীর প্রায় সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণ যথেষ্ট পরিমাণে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ভোগ করে থাকে। স্বাধীনভাবে নিজের মতো প্রকাশের অধিকার প্রাপ্ত জনগণ সরকারের সুপরিচালনার আওতাভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টির দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর এবং একাধিকবার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরেও জনগণের আত্মবিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।
৩. সংস্কৃতি বিখণ্ডিত (Divided culture) : বর্তমান বিশ্বে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রেই বিখণ্ডিত সংস্কৃতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থার বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানা ধরনের সংস্কৃতির অস্তিত্ব দেখা যায়।
আমেরিকার মতো প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে বা অঙ্গরাজ্যে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির চর্চা দেখা যায়। যেমন– ভারতের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রেও বিভিন্ন প্রকার সংস্কৃতির চর্চা দেখা যায়। তাই বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রেও এরূপ বিখণ্ডিত সংস্কৃতির অস্তিত্ব রয়েছে।
৪. সরকার ও জনগণের যোগাযোগের অভাব (Lack of communication between government and public) : কোনো রাষ্ট্রের জনগণের সাথে সংশ্লিষ্টতা সরকারের সাথে জনগণের যোগাযোগ সুপরিচালনা নির্দেশক। সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ উভয়ের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টি করে। নৈকট্য উভয়ের মধ্যে সর্বপ্রকার অস্পষ্টতা ও কোনো প্রকার ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি কোনো সরকারের সাথে সাধারণ জনগণের এরূপ
নৈকট্য সৃষ্টি হয়নি বিধায় সরকার জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে।
৫. সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ (Strong control of government) : বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডের কোনোপ্রকার আলোচনা বা সমালোচনা তা গঠনমূলক হোক বা না হোক সরকার তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। জনগণ বা প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সীমানা অতিক্রম করা ‘Governance’ এর ধারণাকে সংকুচিত করে। সাধারণত গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করে না। সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ সুপরিচালনাকে বিঘ্নিত করে।
৬. বাঙালি ও উপজাতি সংঘাত (Conflict of Bengali and tribe) : বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার উপজাতীয়দের বাঙালিতে পরিণত করতে গিয়ে তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তার জের অদ্যাবধি চলছে। পরবর্তীতে একাধিক সরকার উপজাতীয়দের বাসস্থানসমূহ ছিন্নমূল বাঙালিদের পুনর্বাসন করতে গিয়ে এ সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে। বাঙালি-উপজাতি সংঘাত ও সংঘর্ষের ফলে দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংস পরিবেশ বিদ্যমান থাকায় সক্ষম সরকার ব্যবস্থার সঠিক প্রতিষ্ঠারূপ রক্তঘাতী সংঘর্ষে চিরতরে বিলুপ্ত করে স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। একদিকে যেমন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি উন্নয়নের গতিধারা ব্যাহত হয়েছে। সুপরিচালনা
৭. একাধিকবার সেনা অভ্যুত্থান (Military upheavals at several times) : বাংলাদেশে সামাজিক দুর্নীতি, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। সেনাবাহিনী কখনও জনগণের প্রতিনিধি নয় ফলে জনস্বার্থে প্রশাসন পরিচালনা করা অনাচার, অবিচার, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কারণে চরম বিপর্যয়ে জনগণের অসহায়ত্বের সুযোগে এবং সরকারের ব্যর্থতার সুযোগে তাদের কাছে আশা করা যায় না। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশে একাধিকবার সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক বাহিনীর, সরকার গঠন, সরকার পরিচালনা এসব বিষয়েই সুপরিচালনা বহির্ভূত বিষয়।
৮. সরকার ও বিরোধী দলের সহিষ্ণুতার অভাব (Lack of tolerance of government and opposition party) : উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে যেখানে সরকারি দল ও বিরোধী দল ছায়ার মতো জাতীয় স্বার্থের নিমিত্তে পরস্পরের সাথে মিলিত থেকে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থা এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দলীয় নেতৃবৃন্দ সবসময়ই ব্যর্থ হয়েছে যা বাংলাদেশে সুপরিচালনা বা সুশাসনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
৯. জবাবদিহিতার অভাব (Lack of accountability) : বাংলাদেশে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ এর কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে সুপরিচালনার সংকট থেকে সরকার রেহাই পেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশ সরকার এসব প্রতিষ্ঠানসমূহ সঠিকভাবে তাদের কার্যক্রম জনগণের সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে
সক্ষম হয় নি বিধায় তাদের ব্যর্থতা ও সফলতার পরিমাণ নির্ধারিত হয়নি। একটি রাষ্ট্রের সঠিক কার্য পরিচালনার উপর সরকারের সুপরিচালনা নির্ভর করে।
১০. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতি (Corruption of law and order force) : আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চরম দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সুশৃঙ্খলতা বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্রীয় জীবনের শান্তি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে যে অরাজকতাময় অবস্থার সূত্রপাত করেছে সে পরিস্থিতি ‘Governance’ এর পরিপূর্ণ প্রতিকূল। সভ্যতার ইতিহাসে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে যেখানে কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা বিশ্বব্যাপী, সেখানে পুলিশ হেফাজতে মানুষের নির্বিচার মৃত্যু, একটা দেশের সরকার ব্যবস্থার চরম অব্যবস্থার কথাই স্মরণ করে দেয়।
১১. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ (Failure in establishing democracy) : বাংলাদেশের প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সে সময়কার বিরাজমান অস্থির রাজনীতি, গুপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সফলতা আনতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হন। ফলে ‘Governance’ কখনও সম্ভবপর হয় না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মত সমস্যাসংকুল, অশিক্ষার অভিশাপে অভিশপ্ত, দারিদ্র্যপীড়িত বিপুল জনগোষ্ঠীকে সুপরিচালনার আওতায় আনতে হলে জনগোষ্ঠীকে বিবেকবান, দায়িত্বশীল, সুশিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন। এ বিপুল বিশৃঙ্খল জনগোষ্ঠীকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনা করা যে কোনো সরকারের পক্ষেই অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। জনগণ ও সরকার পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*