নারী উন্নয়নে জাতিসংঘের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, নারী উন্নয়নে জাতিসংঘ কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?
অথবা, নারী উন্নয়নে জাতিসংঘের ভূমিকা ও পদক্ষেপ আলোচনা কর।
অথবা, নারী উন্নয়নে জাতিসংঘের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, নারীর সামগ্রিক উন্নয়নে জাতিসংঘের পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, নারীর উন্নয়নে জাতিসংঘ কী ভূমিকা পালন করে থাকে? বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : ‘
উন্নয়ন’ একটি ব্যাপক শব্দ। ‘উন্নয়ন’ এমনই একটি শব্দ যার ফল একাধারে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ উভয়ের উপকারে আসতে পারে এবং এর সুফল উভয়ে সমানভাবে পেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি যদিও উন্নয়নকে শ্রেণি নিরপেক্ষ বলা হয় কার্যত তা নয়। কারণ সভ্যতার বিকাশের ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে মানবিকতা কম, রয়েছে শুধু পক্ষপাতিত্ব। জাতিসংঘ মানবজাতি সম্পর্কে গবেষণায় দেখতে পায় যে, সমাজে তথা বিশ্বে নারী হচ্ছে সবচেয়ে অবহেলিত। তাই নারীর অধিকার সম্পর্কে সবাইকে সজাগ করে তুলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুতের প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের প্রচেষ্টায় মাত্র ৪০- ৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বের সর্বত্র নারীদের অবস্থান ও পরিবর্তন অনেক উন্নত হয়েছে।
নারী উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা : জাতিসংঘের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেক এবং মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে নারী। মোট শ্রম ঘণ্টার দুই-তৃতীয়াংশ তারা কাজে
নিয়োজিত থাকে। অথচ মোট মজুরির মাত্র এক-দশমাংশ তাদের ভাগ্যে জোটে এবং সম্পত্তির কথা ধরলে মাত্র একশ ভাগের এক ভাগ সম্পদ নারীরা পেয়ে থাকে। নারী উন্নয়ন সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা দেখি পৃথিবীর অসম নাগরিকদের মধ্যে সর্বাধিক অসম হচ্ছে নারীসমাজ। তাদের প্রতি এখনও অস্বীকৃতি ও বৈষম্য বিরাজমান। অথচ একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে নারী- পুরুষের সমানভাবে অংশগ্রহণ। বর্তমান পৃথিবীতে নারীসমাজের অগ্রগতি সাম্প্রতিককালের ঘটনামাত্র। এ প্রেক্ষিতে ত্রিমুখী লক্ষ্য, সমতা, উন্নয়ন ও শান্তির প্রতি আলোকপাত করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ ঘোষণা করে। প্রসে বছর থেকে নারীদের স্বীকৃতি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
জাতিসংঘের ভূমিকা ও পদক্ষেপ : শতাব্দীর বঞ্চিত, অবহেলিত নারীদের অনগ্রসরতা দূর করার জন্যে -পুরুষের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নারী-ধরনের কার্যকরী ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছে। নারী উন্নয়নে জাতিসংঘের ভূমিকা ও পদক্ষেপ
নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. ১৯৪৫ : নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ সনদ গৃহীত ।
২. ১৯৪৬ : নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রসারের উদ্দেশ্যে নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত কমিশন CSW (Commission on Status of Women) গঠিত হয়।
৩. ১৯৪৯ : মানুষ পাচার দমন ও পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে শোষণ অবসানের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক সনদ অনুমোদন।
৪. ১৯৫২ : জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক নারীর রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত সনদ অনুমোদন। এ সনদে প্রথমবারের মত নারীর ভোটাধিকারসহ আইনের অধীনে সমান রাজনৈতিক অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদন লাভ করে।
৫. ১৯৫৭ : স্বামীর কার্যক্রম নির্বিশেষে নারীর জাতীয়তা সংরক্ষণ বা পরিবর্তন করার অধিকার দিয়ে বিবাহিত নারীর জাতীয়তা সম্পর্কিত সনদ গৃহীত।
৬. ১৯৬০ : কর্মসংস্থান ও পেশাক্ষেত্রে বৈষম্য বিলোপ সম্পর্কিত আইএলও (ILO) সনদ গৃহীত ।
৭. ১৯৬২ : সাধারণ পরিষদ কর্তৃক বিবাহ ক্ষেত্রে সম্মতি, বিয়ের ন্যূনতম বয়স ও বিয়ে রেজিস্ট্রিকরণ সম্পর্কিত
সনদ অনুমোদন।
৮. ১৯৬৭ : নারীর বিরুদ্ধে সকল ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সম্পর্কিত ঘোষণা অনুমোদন।
৯. ১৯৭২ : নারীদের সমস্যার উপর গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৭৫ সালকে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ হিসেবে ঘোষণা।
১০. ১৯৭৪ : জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কর্তৃক ১৯৬৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ উপলক্ষে বিশ্ব নারী সম্মেলন আহ্বান।
১১. ১৯৭৫ : জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ পালন। মেক্সিকো সিটিতে প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত ৷ মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ইয়ার ট্রিবিউন (IWYT) প্রথম বিশ্ব কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন করে এবং সমতা, উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্যে প্রথম নারী দশক ঘোষণা করে।
১২. ১৯৭৬ : সাধারণ পরিষদ কর্তৃক জাতিসংঘ নারী দশকের জন্য স্বেচ্ছাসেবামূলক তহবিল এবং নারী প্রগতির জন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রশিক্ষণ ও ইনস্টিটিউট–ইনস্ট্র (INSTRAW) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৩. ১৯৭৯ : সাধারণ পরিষদ কর্তৃক নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও (CEDAW) অনুমোদন।
১৪. ১৯৮০ : নারী প্রগতির জন্য আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (INSTRAW) জাতিসংঘ ব্যবস্থার মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে চালু। জাতিসংঘ নারী দশকের মাঝামাঝি ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নারী সম্মেলনে অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং নারী দশকের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য কর্ম পরিকল্পনা অনুমোদন।
১৫. ১৯৮১ : CEDAW এর কার্যক্রম শুরু।
১৬. ১৯৮৫ : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ম্যান্ডেট অনুসারে সম্প্রসারিত জাতিসংঘ নারী দশক সম্পর্কিত স্বেচ্ছামূলক তহবিল জাতিসংঘ নারী উন্নয়ন তহবিল বা ইউনিফেম (UNIFEM) নামে জাতিসংঘ উন্নয়ন কার্যক্রম (UNDP) এর সাথে সংশ্লিষ্ট একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপলাভ। নাইরোবীতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বিশ্ব নারী সম্মেলনে
২০০০ সাল নাগাদ নারী প্রগতির জন্য নাইরোবী অগ্রমুখী কর্মকৌশল (NFLS) গৃহীত।
১৭. ১৯৮৮ : উন্নয়নে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে প্রথম বিশ্ব জরিপ অনুষ্ঠিত।
১৮. ১৯৯০ : নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত কমিশন (ESW) কর্তৃক নাইরোবী অগ্রমুখী কৌশল (NFLS) বাস্তবায়ন পর্যালোচনা । চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন আহ্বানের সুপারিশ।
১৯. ১৯৯১ : নারীদের অবস্থা সম্পর্কে উপাত্তের বা ডাটার (data) একটি সঙ্কলন বিশ্বের নারী প্রবণতা ও পরিসংখ্যান প্রকাশ ।
২০. ১৯৯২ : জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে (UNCED) পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি।
২১. ১৯৯৩ : ভিয়েনা বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি ও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং নারীর অন্যান্য মানবাধিকারজনিত সমস্যাকে জাতিসংঘের সার্বিক মানবাধিকার কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ডের সাথে একীভূতকরণ। নারী নির্যাতন সংক্রান্ত একজন বিশেষ যোগাযোগ রক্ষাকারী কর্মকর্তা নিয়োগের সুপারিশ। সাধারণ পরিষদ কর্তৃক নারীর প্রতি সহিংসতা দূরীকরণ সম্পর্কিত ঘোষণা অনুমোদন।
২২. ১৯৯৪ : কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনে নারী ক্ষমতায়নকে প্রথমবারের মত উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিতকরণ। চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের জন্য আঞ্চলিক প্রস্তুতিমূলক প্রক্রিয়াস্বরূপ ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, আফ্রিকা, জর্ডান ও সেনেগালে আঞ্চলিক বৈঠক সম্পন্ন।
২৩. ১৯৯৫ : সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলনের (World Social Summit) কর্মসূচিতে নারীবাদ সমস্যার পুরো বিষয় প্রতিফলিত। খসড়া ঘোষণায় পূর্ণ সমতা নিশ্চিতকরণের প্রতিশ্রুতিতে অন্তর্ভুক্ত।
২৪. বেইজিং : বেইজিং এ অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে দশটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পর্যালোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত এবং বৈশ্বিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নারী উন্নয়নের একটি বিশ্ব রূপরেখাস্বরূপ বেইজিং প্লাটফরম ফর এ্যাকশন (PFA) গৃহীত।
২৫. ২০০০ : নিউইয়র্কে জুন মাসে ‘বেইজিং’ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচায় শেষে বলা যায়, জাতিসংঘ নারী উন্নয়নের জন্য অনেক সময় কার্যকরী পন্থা গ্রহণ করেছে। একসময় নারীরা ছিল অবহেলিত ও অধিকার থেকে বঞ্চিত। জাতিসংঘ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ বিরাট ভূমিকা পালন করে। নারীদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে বিরাট Gap ছিল তা পূরণে জাতিসংঘ সচেষ্ট হয়। বিভিন্ন দেশের সরকারকে এক একটি এলাকা চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ নারীর উন্নয়নের জন্য পরামর্শ প্রদান করে। ফলে আগে যে সমস্যা ছিল সে সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যেত না। এলাকা ভাগ করে গবেষণার ফলে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়ার সমস্যা দূর হয়। জাতিসংঘ এসব সমস্যা সমাধানেও ব্রতী হয়েছে। জাতিসংঘের নারী উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে নারী আন্দোলন কর্মসূচি জোরদার হয়। সবচেয়ে বড় কথা, জাতিসংঘের কার্যকরী পদক্ষেপের ফলেই নারী সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান, সঠিক তথ্য, জ্ঞান, তার সমস্যা ও সমাধানের সঠিক ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়েছে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*