নারীর প্রতি সহিংসতার স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র তুলে ধর।
অথবা, নারীর প্রতি সহিংসতার স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নারীর প্রতি সহিংসতার স্বরূপ সম্পর্কে বর্ণনা কর
অথবা, নারীর প্রতি সহিংসতার স্বরূপ সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষ্যে দৈনিক ইত্তেফাকের একটি রিপোর্টে বলা হয়- “সমাজ যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে তার দুই বাহু হলো নারী ও পুরুষ। একটিকে বাদ দিলে সমাজকাঠামোর দৈন্যদশা কখনও ঘুচবে না। একথা মনে রাখতে হবে যে, নারী মানব সম্পদের, বিশ্ব উন্নয়নের দীর্ঘদিনের দাবিদার। তার অধিকার বারবার অস্বীকার করা হয়েছে বলেই পৃথিবীতে এত হানাহানি চলছে।” [৮ মার্চ ২০০২, পৃঃ ১২] আর বিশ্বব্যাপী এ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হানাহানির ক্ষেত্রে একটি ভয়াবহ রূপ হলো নারীর প্রতি সহিংসতা। নারী নির্যাতন ও সহিংসতা কথা দু’টি প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও সহিংসতা বলতে নারী নির্যাতনের একটি অংশকে বোঝানো হয়। নারী নির্যাতন বলতে নারীর শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের নির্যাতনকে বুঝায়। কিন্তু সহিংসতা হলো এমন একটি পর্যায় যেখানে নারীকে শুধুমাত্র শারীরিকভাবে উৎপীড়নের শিকার হতে হয়। গত দুই দশক ধরে নারীর প্রতি সহিংসতা আমাদের দেশে অন্যতম সামাজিক ইস্যু হিসেবে আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে। নারীর প্রতি সহিংসতার এক বা একাধিক ঘটনা খবরের কাগজে ছাপা হয়নি এমন দিন পাওয়া দুষ্কর।
নারী নির্যাতনের স্বরূপ : নারী নির্যাতনের পরিধি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ নির্যাতন রূপ নিচ্ছে সহিংসতার। নারী নানাভাবে এ সহিংসতার শিকার হচ্ছে। নিম্নের তালিকা থেকে এ সম্পর্কিত একটি ধারণা আমরা পেতে পারি।
নিম্নে নারীর প্রতি সহিংসতার স্বরূপ আলোচনা করা হলো :
১. ধর্ষণ : জোরপূর্বক, নারী ও শিশুর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টাকে বলা হয় ধর্ষণ। সারা দেশে ধর্ষণ ছোঁয়াচে ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে। এখন ধর্ষণ হচ্ছে অনেকটা প্রকাশ্যে। নারীকে জোর করে অপহরণ করে ধর্ষকেরা দলবেধে পালাক্রমে রাতভর ধর্ষণ করছে। আবার অনেক সময় ধর্ষণের পর নারীকে হত্যা বা খুনও করা হচ্ছে। এ হলো
নারীর প্রতি সহিংসতার এক ভয়াবহ ও ঘৃণ্যতম রূপ। এটা মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর। কারণ, না। কিন্তু ধর্ষণের দ্বারা ধর্ষিতা নিজেই কলংকিত হয়। বাস্তব উদাহরণ : সীমা ধর্ষণ, ইয়াসমীন হত্যাকাণ্ড ।
২. বিয়ে : প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও নারীর দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের বৈধ মাধ্যমকে বলা হয় বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পুরুষ নারীকে তার ভোগ্য বস্তু ও যৌন চাহিদা মিটানোর উপকরণ হিসেবে দেখে। তাই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন পুরুষের জন্য প্রাপ্তি বয়ে আনলেও নারীরা শারীরিকভাবে তৃপ্ত হয় না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এ শারীরিক সম্পর্ক তাদের কাছে অত্যাচারের সামিল বলেই মনে হয় এবং আমাদের দেশের নারীরা অবলা হওয়ার কারণে মুখ ফুটে কিছু
বলতেও পারে না। কাজেই, এটাকেও নারীর প্রতি সহিংসতার একটা দিক হিসেবে উল্লেখ করা অযৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না।
৩. নারী হত্যা : বর্তমানে বাংলাদেশে নারী হত্যা একটি সাধারণ চিত্র। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই হয়ে থাকে যৌতুক ও বহুবিবাহের কারণে। নারী হত্যা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, যথা : আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, নারীকে পিটিয়ে হত্যা,বটি বা কুপিয়ে হত্যা, শ্বাসরোধ করে হত্যা, বিষ খাইয়ে হত্যা প্রভৃতিসহ আরও বহুধরনের হত্যা আমাদের সমাজে প্রতিনিয়তই সংঘটিত হচ্ছে। যার ফলে দিন দিন নারী নির্যাতনের মামলাও বেড়েই চলেছে।
৪. গর্ভপাত : গর্ভপাতের দ্বারাও নারী সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। নারীরা না চাইলেও অনেক সময় তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভপাত ঘটানো হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষত চীন, ভারত, কোরিয়ায় বেআইনি হওয়ার পরেও কন্যা ভ্রুণ হত্যা করা হয়। এভাবে অকালে বারবার গর্ভপাত ঘটানো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং এর কারণে প্রায়ই নারীর অকাল মৃত্যু ঘটে থাকে। এটিও নারীর প্রতি সহিংসতার একটি বিশেষ রূপ ।
৫. পতিতাবৃত্তি : অর্থের লালসায় আমাদের দেশের পুরুষেরা শিশু কিংবা যুবতী মেয়েদের কাজের প্রলোভন ও অন্যান্য প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করে এবং পতিতালয়ে বিক্রি করে। পরবর্তীতে তাদেরকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশের গ্রামের দরিদ্র মেয়েরা বিভিন্ন কুচক্রীমহলের খপ্পরে পরে এ ধরনের ঘটনার শিকার বেশি
হয়। যেহেতু তারা স্বতঃস্ফূর্ত বা ইচ্ছাকৃতভাবে এ পেশায় নিয়োজিত হয় না, তাই পতিতাবৃত্তিকে নারীদের প্রতি এক ধরনের সহিংসতাই বলা চলে।
৬. সৌন্দর্য পীড়ন : নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে গিয়েও নারীকে হতে হয় শারীরিকভাবে নির্যাতিত। অনেক দেশে প্রচলিত সৌন্দর্যের চিহ্নস্বরূপ নারীর দেহে বিশেষত মুখমণ্ডলে স্থায়ী ক্ষত চিহ্ন সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। যেমন- সুদানে মেয়েদের মুখে স্থায়ী চিহ্ন দেওয়া হয়, চীনে মেয়েদের পা ছোট রাখার জন্য লোহার জুতা পড়ানো হয়, আদিবাসী নারীদের
নাক বা কান ফুটো করে অনেক ভারী লোহা বা অন্য ধাতুর অলংকার পড়ানো হয়। [জেন্ডার প্রসঙ্গ, শাহীন রহমান, পৃ: ৪২]
৭. এসিড নিক্ষেপ : সময়ের সাথে সাথে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে যে নতুন মাত্রাটি যোগ হয়েছে, তা হলো এসিড নিক্ষেপ। এ তরল আগুনে মেয়েদের শরীর বা মুখমণ্ডল পুড়িয়ে দেবার পিছনে মূলত দু’টি কারণ রয়েছে। যথা :প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। যার ফলশ্রুতিতে অহরহই প্রতিহিংসার বসে মানুষরূপী হিংস্র পশুরা এসিড নিক্ষেপ করে
বিভৎস করে দিচ্ছে নারীর মুখমণ্ডলকে। আর এ ঘৃণ্যতম কাজের জন্য নারীদেরকেই সারা জীবন মাশুল দিয়ে যেতে হয়।
৮. ফতোয়ার শিকার : দেশের প্রচলিত আইনকে অবমাননা করে ফতোয়া জারি করে নারী হত্যা নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম জঘন্য রূপ। সাধারণত ইসলামি শাস্ত্রানুযায়ী রায় দেওয়াকে ফতোয়া বলা হয়। কিন্তু সমাজের অশিক্ষিত মোল্লারা এ. ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করে ফতোয়া দেন গ্রাম্য সালিশের দ্বারা। এ নির্মম ফতোয়া সাধারণত প্রদান করা হয় প্রেম ও বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে। ফলে সকলক্ষেত্রেই ফতোয়ার শিকার হয় নারীরা। উদাহরণ : প্রতারণার শিকার হয়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জের ধরে অন্তঃসত্তা হয়ে পড়ায় গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ১৫ বছর বয়সি এক তরুণীকে প্রকাশ্যে ৩৫ দোররা মেরে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। [উৎস : দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৫)
৯. নারী খত্না : নারীকে নির্যাতন করার আরেকটি পন্থা হচ্ছে যৌনাঙ্গ কর্তন। বিশ্বের ২৮টি দেশে এখনও এ সামাজিক কুপ্রথা প্রচলিত আছে। এ যাবৎ প্রায় ১২ কোটি নারীর যৌনাঙ্গ কর্তন বা খত্না করা হয়েছে এবং প্রতি বছর ২০ লাখ নারী/বালিকা এ ঝুঁকির সম্মুখীন। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি কন্যা শিশুর খত্না বা ভগাঙ্গুর (Clitoris)
ছিন্ন করা হয়। জিবুতি, মালি, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান ইত্যাদি দেশে প্রায় সকল নারীই এ প্রথার দ্বারা আক্রান্ত । অথচ এর ফলে নারীদের বাধ্যাত্ম, প্রসবকালীন মৃত্যু এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। [জেন্ডার প্রসঙ্গ, শাহীন রহমান, পৃঃ ৪২]
১০. যৌতুক সম্পর্কিত : বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার পিছনে যে ক্রিয়াশীল কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে যৌতুক প্রথা অন্যতম। বিয়ের পর নারীকে তার বাবার বাড়ি থেকে নানা ধরনের যৌতুক আনার জন্য তার স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য সদস্য কর্তৃক চাপ প্রয়োগ করা হয়। ফলে নারীর বিবাহিত জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠে। যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা, পুড়িয়ে হত্যা, জবাই করে হত্যা, অত্যাচার করে অন্ধ করে দেওয়া, বিকলাঙ্গ করে দেওয়া প্রভৃতি আমাদের সমাজে হরহামেশাই হচ্ছে। নারী সহিংসতার এ রূপটি সমাজে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
১১. পুত্র সন্তান ধারণে অক্ষম হলে : দরিদ্র কৃষিভিত্তিক সমাজে মেয়েদেরকে দেখা হয় বোঝা রূপে, আর ছেলে সন্তান হলো ভবিষ্যতের আয় উপার্জনকারী। তাই কোনো নারী যদি পুত্রসন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হয় তাহলে কারণ বিবেচনা না করেই তার উপরে নৈমে আসে অকথ্য অত্যাচার।
১২. কর্মক্ষেত্রে : কর্মক্ষেত্রেও নারীরা অনেক সময় পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছনা ও সহিংসতার শিকার হয়। আবার চাকরি হারানোর ভয় দেখিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য নারীর শেষ সম্বল ইজ্জতটুকুও কেড়ে নেয়।
১৩. হেফাজতকালীন নির্যাতন : নারীরা যখন থানা হাজত বা জেল হাজতের হেফাজতে থাকে তখন অভ্যন্তরীণ অবস্থায় পুলিশী হেফাজতে তারা পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণের ও হত্যার শিকার হয়ে থাকে। যেমন- ইয়াসমীন হত্যাকাণ্ড।
উপসংহার : সার্বিক আলোচনার প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি সহিংসতার যে জঘন্যতম রূপ আমরা দেখতে পাই, তা কেবল সমাজজীবনকে কলুষিতই করছে না, বরং সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে এক চরম বিপর্যয়ের দিকে। দেশের অর্ধেক অংশ নারী সমাজকে রক্ষা করার জন্য যে কোনো ধরনের কঠোর আইন প্রণয়ন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে আইনের বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু আইন প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, সমাজের মানুষরূপী জানোয়ারদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে। আর এজন্য মানবতাবাদী, উদার ও মুক্তচিন্তার অধিকারী সব মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*