সামাজিক গবেষণা বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশের সামাজিক গবেষণার সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা আলোচনা কর ।

অথবা, সামাজিক গবেষণা কী? বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ চিহ্নিত কর।
অথবা, সামাজিক গবেষণার সংজ্ঞা দাও। সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেম সীমাবদ্ধতাগুলো বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বর্তমানে সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক বিজ্ঞানের মূল আলোচ্যবিষয় মানুষ ও তার আচরণ। বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞান নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা পরিচালনা করে । সমাজিক বিজ্ঞানসমূহে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বা সামাজিক প্রপঞ্চের প্রকৃতি উদঘাটনের জন্য যেসব গবেষণা পরিচালনা করে তাকে সামাজিক গবেষণা বলে । সমাজিক গবেষণার মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের সমস্যা নির্ধারণ ও সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ।
সামাজিক গবেষণা : সামাজিক গবেষণা বলতে বুঝায় সমাজ ও ব্যক্তির বিশ্লেষণ । সমাজ ও ব্যক্তির জীবনে নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যাখ্যা সামাজিক গবেষণার মৌলিক প্রয়াস। সমাজ ব্যক্তি ক্রিয়ার সমষ্টিগত রূপ, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সমাজের প্রাণ । সামাজিক গবেষণা এ মিথষ্ক্রিয়াজাত উপাদান ও ঘটনাবলির বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সামাজিক গবেষণা সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে তাদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
পলিন ভি. ইয়ং (Pauline V. Young) এর মতে, “In brief and provisionally, social research may be defined as a scientific undertaking which, by means of logical and systematized techniques, aims to : 1. discover new facts or verify and test old facts; 2. analyze their sequences, interrelationships and causal explanations which were derived within an appropriate theoretical frame of reference; 3. develop new scientific tools, concepts and theories which would facilitate reliable and valid study of human behaviour. অর্থাৎ, সামাজিক গবেষণাকে যৌক্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক কৌশলের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যার উদ্দেশ্য হলো :
১. নতুন সত্য বা ঘটনা আবিষ্কার অথবা পুরাতন ঘটনাকে যাচাই করা;
২. তাদের অনুক্রম, আন্তঃসম্পর্ক এবং কারণঘটিত ব্যাখ্যার বিশ্লেষণ করা;
৩. নতুন বিজ্ঞানভিত্তিক কৌশল, প্রত্যয় এবং তত্ত্বসমূহকে উন্নত করা ।
পলিন ভি. ইয়ং (Pauline V. Young) আরো বলেন, “Social research is a systematic method of exploring, analyzing and conceptualizing social life in order to extend, correct or verify knowledge, whether that knowledge aid in the constructing of a theory or in the practice of an art. অর্থাৎ, সামাজিক গবেষণাকে আমরা সমাজজীবনের অন্বেষণ, বিশ্লেষণ ও ধ্যানধারণার একটি পদ্ধতি রূপে আখ্যা দিতে পারি, যার উদ্দেশ্য জ্ঞান বিস্তার, সংশোধন ও যাচাই । এ জ্ঞানতত্ত্ব গঠনে বা ব্যবহারিক জীবনে সাহায্য করতে পারে ।
ওয়েস্টার মার্ক (Wester March) এর মতে, “জ্ঞান অর্জনই শুধু গবেষণার লক্ষ্য নয়, এর উদ্দেশ্য সমাজজীবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞান সমাজের জন্য প্রয়োগ করা।”
কে. ডি. বেইলি (K. D. Bailey) তাঁর ‘Methods of Social Research’ গ্রন্থে বলেন, “সামাজিক গবেষণা . উপাত্ত সংগ্রহের সাথে সম্পৃক্ত, যা সমাজের বিভিন্ন উপাদান সম্বন্ধে প্রশ্নের উত্তর দিতে সহায়তা করে।” উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে তিনটি বিষয় লক্ষ করা যায়। যেমন- সামাজিক গবেষণা হচ্ছে সামাজিক জীবন সম্বন্ধে অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ, ধারণা ও তত্ত্ব গঠন করার একটি সুসংবদ্ধ পদ্ধতি; যার উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানভাণ্ডারের সমৃদ্ধি সাধন, সংশোধন এবং তার প্রতিপালন করা।
বাংলাদেশের সামাজিক গবেষণার সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা : নিম্নে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
প্রথমত, বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা হলো তথ্যসংগ্রহ করা। গবেষক যাদের কাছ থেকে তথ্যসংগ্রহ করেন তাদের অনেকেই সঠিক তথ্য প্রদানে উৎসাহবোধ করেন না। বিশেষকরে বিরাট গ্রামীণ জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রেই তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় না থাকায় তথ্য প্রদান করতে অনীহা প্রকাশ করে । ফলে তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে জটিলতার হয়।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই অদৃষ্টবাদী, তারা ভাগ্যে বিশ্বাস করে। ফলে যে কোনো দুর্যোগ বা বিপদ আপদে ভাগ্যের উপর নির্ভর করে কোনো ধরনের প্রচেষ্টা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখেন। এ রকম সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সঠিকভাবে গবেষণা কাজ পরিচালনা করা সম্ভবপর হয় না।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের সামাজিক গবেষণার আর একটি সমস্যা হলো এখানে গবেষকের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি, অভ্যাস ইত্যাদির প্রভাব লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ এখানে গবেষকগণ অনেক সময়পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয় না।
চতুর্থত, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে । ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে আমাদের দেশের অনেক মহিলাই তথ্যানুসন্ধানকারী বা পুরুষ লোকের নিকট তথ্য প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে । ফলে তাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্যসংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়নি।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের লোক বাস করে বিধায় তাদের অভ্যাস, সামাজিক অবস্থা, পরিবেশ ইত্যাদির মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় । ফলে সমজাতীয় উপাত্ত সংগ্রহে অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
ষষ্ঠত, বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে আর একটি সমস্যা হলো ভালো বা দক্ষ অনুসন্ধানকারীর অভাব । এদেশে মানসম্পন্ন এবং দক্ষ অনুসন্ধানকারীর কারণে সঠিক ও নির্ভুল তথ্যসংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়নি।
সপ্তমত, বাংলাদেশে অনেক তথ্যসংগ্রহকারী কিছু পাবার প্রত্যাশায় অতিরঞ্জিত করে তথ্য প্রদান করে । ফলে সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভবপর হয়নি। যেমন- এদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের উদ্দেশ্যে জনগণের ক্ষয়ক্ষতির উপর তথ্যসংগ্রহ করা হয়। তখন অনেকে সাহায্য পাবার আশায় নিজেদের সুবিধামতো তথ্য প্রদান করে।
অষ্টমত, বাংলাদেশ দারিদ্র্য পীড়িত দেশ। এদেশের অনেক জনগোষ্ঠী ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার হিসেবে মিলানোর চেষ্টা করে । অর্থাৎ যেসব বিষয়ে কোনো স্বার্থ থাকে না সেসব বিষয়ে তারা আগ্রহ দেখায় না। ফলে তথ্যসংগ্রহকারীর কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেলে তারা তথ্য প্রদানে তেমন সময় নষ্ট করতে চায় না ।
নবমত, বাংলাদেশে বয়স্কদেরকে বেশি সম্মানের চোখে দেখা হয়। ফলে বয়স্কদেরকে বাদ দিয়ে অনেক সময় অন্যদের কাছ থেকে তথ্যসংগ্রহ করা সম্ভবপর হয় না। তাছাড়া গ্রামীণ অনেক এলাকায় বয়স্কদের সামনে অন্যরা কোনো তথ্য প্রদানে সচেষ্ট হয় না। কেননা তাতে বয়স্কদের সম্মানহানি হতে পারে। ফলে তথ্যসংগ্রহকারী বয়সজনিত সম্মান প্রদর্শনের কারণে সঠিক ও নির্ভুল উপাত্ত সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন যা বাংলাদেশের সামাজিক গবেষণার একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে মনে করা হয় ।
দশমত, বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটুকু সুদৃঢ় নয়। ফলে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্বারা তথ্যসংগ্রহ করা হলে অনেকে তা সহজভাবে গ্রহণ করে না এবং তথ্য প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে । তাছাড়া সঠিক তথ্য প্রদান করলে কর আরোপ বা অন্য কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন এই আশঙ্কায় সঠিক তথ্যও প্রদান করেন না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার সুস্পষ্ট পদচারণা শুরু হলেও নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও সমস্যার কারণে গবেষণা কর্মের ধারা ও সামর্থ তেমন সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং গণসচেতনার মাধ্যমে এ সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রয়াস অপরিহার্য । উল্লিখিত সীমাবদ্ধতার পরিসর থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয়তা উন্নত বিশ্বেও সমাদৃত হবে এবং দেশ হবে কল্যাণমুখী ও উন্নত ।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*