সামাজিক অসমতা কী? বয়স, লিঙ্গ ও শ্রেণিভেদে সামাজিক অসমতার কারণগুলো আলোচনা কর ।

অথবা, সামাজিক অসমতা কাকে বলে? বয়স, লিঙ্গ, ও শ্রেণিভেদে সামাজিক অসমতার কারণগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক অসমতা বলতে কী বুঝ? বয়স, লিঙ্গ ও শ্রেণিভেদে সামাজিক অসমতার কারণগুলো সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
প্রকৃতির অসম বণ্টন সম্পদের শ্রেণিবিভাজনে সকল মানুষ সমান হলেও সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অসমান। সামাজিক অসমতা একটি সমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। সমাজ পরিবর্তনের ধারায় এ অসমতা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম রূপ ধারণ করেছে। বিরাজমান সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন রকম অসমতা লক্ষণীয়। এ অসমতা নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন। পৃথিবীতে এমন কোনো সমাজ নেই, যেখানে সামাজিক অসমতার অস্তিত্ব নেই। সমাজে আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ও অন্যান্য দুর্লভ উপাদানের অসম বণ্টনের ফলে সৃষ্ট অসমতাই হলো সামাজিক অসমতা।
অসমতা : আভিধানিক অর্থে অসমতা বা Inequality শব্দটি Equality শব্দটির বিপরীত। যার অর্থ হচ্ছে ‘সমান হওয়া’ (State of seing equal)। তাহলে Inequality শব্দের অর্থ হচ্ছে অসমান হওয়া। আবার আকৃতি ও মাত্রা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমতার অভাবই হচ্ছে ‘অসমতা’।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সামাজিক অসমতার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের সংজ্ঞা প্রদান করা হলো : ‘Encyclopedia of Sociology’ গ্রন্থে অসমতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Elmer (1981) বলেছেন, “সামাজিক অসমতা বলতে বুঝায় এমন একটি অবস্থা যেখানে সমাজের সদস্যবৃন্দ অসম পরিমাণ বা মাত্রায় সম্পদ, খ্যাতি বা ক্ষমতার অধিকারী হয়।”
“সামাজিক অসমতা উইলিয়াম পি. স্কট (Willam P. Scott) তাঁর ‘Dictionary of Sociology’ গ্রন্থে বলেন, বলতে গোষ্ঠী বা সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের কারণে অসম সুযোগ সুবিধা এবং অসম পুরস্কারের অস্তি ত্বকে বুঝায় ।” রবার্টসন (Robertson) বলেছেন, “Social Inequality exists when some people have greater share of power, wealth on prestige than others.” অর্থাৎ, যখন সমাজের কতিপয় লোক অন্যান্যদের তুলনায় বেশি ক্ষমতা, সম্পদ অথবা খ্যাতির অধিকারী হয় তখন সেখানে সামাজিক অসমতা বিরাজ করছে বলা চলে। Smelser, “Inequality can be defined as a condition in which people do not have equal access to social rewards anything that is valued and viwed as scarce can be seen as a reward to which people can have unequal access.” অর্থাৎ, সামাজিক অসমতা বলতে এমন একটি অবস্থাকে বুঝায় যখন সমাজের পুরস্কারগুলোতে সবার সমান অধিকার বর্তায় না। সমাজের যা কিছু দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান বলে বিবেচিত হয় সেগুলোকেই বলা হয় পুরস্কার-আর এ সবেই থাকে অসম অধিকার। সামাজিক বৈষম্য বা অসমতা প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান তাঁর ‘সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি’ বইয়ে (৪র্থ সংস্করণ,
পৃঃ ৩৬৫) বলেছেন, “সামাজিক অসমতার অর্থ হচ্ছে মর্যাদা, ক্ষমতা, সম্পদ ইত্যাদির অসম বণ্টন।” পরিশেষে বলা যায় যে, সম্পত্তি, ক্ষমতা, মর্যাদা এবং জীবনের অন্যান্য অনেক সুযোগ সুবিধার প্রেক্ষিতে পারস্পরিক
যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তাই হলো সামাজিক অসমতা। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে (১৭৬০-১৮৫০) যে নব জাগরণের সৃষ্টি হয় তা থেকেই শ্রেণি বৈষম্যের সৃষ্টি। বয়সভেদে সামাজিক অসমতা (Social Inequality by age) : যেসব জৈবিক উপাদান সামাজিক অসমতার জন্য দায়ী, তার মধ্যে বয়স অন্যতম। বয়োবৃদ্ধি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রেই জন্মের পর থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং তা আমরণকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। বয়োবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক হলেও বিভিন্ন বয়সের মানুষের প্রতি যে বিভিন্নতা প্রকাশ পায় তা কেবল প্রাকৃতিক তথা বয়সের পার্থক্যের উপরই নির্ভর করে না, এ মনোভাবের উপর মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপাদান দ্বারাই মনোভাব প্রভাবিত হয়। সামাজিক কাঠামো বয়সের উপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। কোনো কোনো সমাজ আছে যেখানে বৃদ্ধদেরকে বেশি সম্মান ও শ্রদ্ধা করা হয়, আবার এমন পরিবেশ আছে যেখানে বৃদ্ধদেরকে বোঝা মনে করা হয়। অর্থাৎ এমন অনেক সমাজ আছে যেখানে প্রবীণদের প্রতি অনেকেই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ ও বিদ্বেষমূলক আচরণ প্রদর্শন করে। আবার এমন অনেক সমাজ আছে, যেখানে প্রবীণদের প্রতি সমাজের প্রগাঢ় শ্রদ্ধাভক্তি নিবেদন করা হয় ও বয়সের
বিচারে তাদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। অর্থাৎ আমরা দেখছি সামাজিক কাঠামোর ভিন্নতায় প্রবীণ ব্যক্তিরা ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন রকম ব্যবহার পেয়ে থাকে। লিঙ্গভেদে সামাজিক অসমতা (Social Inequality by Sex) : প্রাকৃতিক তথা জৈবিক পার্থক্য বিচারে সব মানুষ পুরুষ ও মহিলাতে বিভক্ত। মহিলা-পুরুষভেদে যে অসমতা তা মানবসৃষ্ট নয়। অথচ মানবসমাজে এটাই প্রথম ও মৌলিক অসমতা। এ অসমতার মূল কারণ এই যে, মহিলারা সন্তান ধারণ করে, সন্তানদের দুগ্ধ পান করায় এবং শিশু লালনপালনে তাদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি স্বীকার্য। সন্তান জন্মদান ও লালনপালন করতে হয় বিধায় মহিলারা গৃহের কাজেই আটকে পড়ে।
শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্যের ভিন্নতার কারণে পুরুষ ভারী কাজে অংশ নেয় এবং মহিলারা তুলনামূলক হালকা কাজে অংশ নেয়। এভাবে পুরুষেরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ, শিকার, পশুপালন, সমুদ্রে মাছ ধরা, নৌকা চালান এবং হালচাষ ইত্যাদি কাজ করে। পুরুষদেরই সরকার পরিচালনা করতে হয়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে এবং তাও নগণ্য। অধিকার সংক্রান্ত বিচারকার্য প্রধানত পুরুষরাই করে থাকে। গৃহে বা সভা-সমিতিতে পুরুষরাই নেতৃত্ব দেয়। এমনকি অধিকাংশ সমাজেই একজন অবিবাহিত মহিলার অভিভাবক হচ্ছেন পুরুষ। বিবাহিত হলে স্বামী। এর বিপরীত রীতি একান্তই কম। এ কারণেই সহজ-সরল প্রযুক্তিনির্ভর ক্ষুদ্রাকৃতির সমাজসহ অনেক সমাজেই মহিলারা যেন গৌণ (minor). প্রায় সমাজেই পুরুষরা ধর্মীয় কাজে নেতৃত্ব দেয়। কোনো কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মহিলাদের অংশগ্রহণও সীমিত। অবশ্য কিছু সমাজে এমন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আছে, যাতে কেবল মহিলারাই যোগ দেয়। এমন সমাজের অভাব নেই, যেখানে মহিলারা পুরুষের সাথে বসে না বা বসার অধিকার প্রচলিত নেই। স্বামী বা বাড়ির পুরুষ ব্যক্তিদের আহার শেষ না হলে মহিলারা আহার করে না। মহিলাদের কাজের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কম সমাজেই স্বীকার করা হয় । অতএব লক্ষণীয় যে, স্ত্রী-পুরুষভেদে বা লিঙ্গভেদে সামাজিক অসমতা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে জৈবিক কারণ ছাড়াও সমাজ ও সংস্কৃতির কিছু কিছু নিয়মনীতি, সংস্কার ও মূল্যবোধ অনেকটা দায়ী।band শ্রেণিভেদে সামাজিক অসমতা (Social Inequality by Class) : আধুনিক সমাজে অসমতা বলতে শ্রেণি ও পদমর্যাদা এ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। Marxপুঁজিবাদী সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে শ্রেণির কথা বলেছেন। তিনি শ্রেণিসংগ্রাম বলতে বুঝিয়েছেন, “A group of individuals who perform some function in the organization of production.” তিনি সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে দুটি শ্রেণির কথা বলেছেন । যথা :
১. উৎপাদনের মালিক (Owner of means of production) এবং
২. উৎপাদনের মালিক (Non- Owner of means of production). 22 Marx শ্রেণির চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন । যথা :
১. শ্রেণি সাধারণত উৎপাদন সংগঠনে একই ধরনের ভূমিকা পালন করে। যেমন-বাংলাদেশের সমাজে প্রধানত দুটি শ্রেণি দেখা যায় । যথা : ভূমি মালিক ও ভূমিহীন।
২. মানব ইতিহাসে প্রত্যেকটি পর্যায়ে উৎপাদন মালিকানা এবং সমমালিকানার ভিত্তিতে শ্রেণি গড়ে উঠে
৩. শ্রেণিগুলো তাদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন থাকে।
৪. শ্রেণিগুলো সর্বদা শ্রেণিসংগ্রামরত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, জাতিবর্ণ প্রথা, শ্রেণি, বয়স ও লিঙ্গভেদে সামাজিক অসমতার সৃষ্টি করে। তবে তুলনামূলকভাবে জাতি-বর্ণ-প্রথা সামাজিক সমতার জন্য বেশি দায়ী। কেননা জাতি বর্ণের সদস্যপদ যেহেতু জন্মের দ্বারা নির্ধারিত, অন্তর্বিবাহ যার অন্যতম রীতি, তাতে জাতি-বর্ণ প্রথা সমাজে অনেকটা স্থায়ী অসমতার জন্য দায়ী।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*