সামাজিক অসমতার উপাদানসমূহ আলোচনা কর ।

.

অথবা, সামাজিক অসমতার উপাদানসমূহ কী কী বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক অসমতার নির্ধারক সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক অসমতার নির্ধারকগুলো কী কী? বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক অসমতার নির্ধারকগুলো সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানবসমাজ প্রকৃতিগত বিচারে বৈচিত্র্য ও সাদৃশ্যপূর্ণ। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, জাতিধর্ম, শিক্ষা, পেশা, আয় প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের ভিত্তিতে যে শ্রেণিবিভাগ তাকেই সামাজিক অসমতা বলে। বস্তুত, Social Stratification সাম্প্রতিককালে Social Inequality নামে পরিচিত। সমাজজীবনে সাধারণ সত্য হলো অসমতা।
সামাজিক অসমতার নির্ধারক বা উপাদান : যেসব উপাদান সামাজিক অসমতাকে নির্ধারণ করে সেসব উপাদানই সামাজিক অসমতার নির্ধারক। নির্ধারকগুলো হচ্ছে সামাজিক অসমতার ভিত্তি। এ উপাদানগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় । যথা :
i. জৈবিক উপাদান বা (Biological factors) এবং
ii. সামাজিক উপাদান বা (Non biological or social factors)।
i. জৈবিক উপাদান এবং সামাজিক অসমতা : নিম্নে সামাজিক অসমতার জন্য দায়ী জৈবিক উপাদানগুলো আলোচনা করা হলো :
১. লিঙ্গগত অসমতা : প্রাকৃতিক তথা জৈবিক পার্থক্য বিচারে সব মানুষ মহিলা ও পুরুষে বিভক্ত। মহিলা ও পুরুষে যে বিভেদ তা মানব সৃষ্ট নয় অথচ মানবসমাজে এটিই প্রথম মৌলিক প্রভেদ বা অসমতা। শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্যের বিভিন্নতার কারণে পুরুষ ভারী কাজে এবং মহিলারা তুলনামূলকভাবে হালকা কাজে অংশগ্রহণ করে। শিকার ও সংগ্রাহক
সমাজে অসমতার রূপ ছিল লিঙ্গ ভিত্তিক। স্ত্রী পুরুষভেদে সামাজিক অসমতার ক্ষেত্রে জৈবিক কারণ ছাড়াও সমাজ ও সংস্কৃতির কিছু নিয়মরীতি, সংস্কার ও মূল্যবোধ কমবেশি দায়ী থাকে। স্ত্রী ও পুরুষভেদে বৈষম্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে অমানবিক ও অগণতান্ত্রিকও বটে। আর এ কারণে আজকের যুগে শিল্পায়িত সমাজে নারীমুক্তি আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
২. বয়সভিত্তিক অসমতা : প্রতিটি সমাজের জনসংখ্যা বয়সের তারতম্য বিচারে বিভক্ত। মূলত জৈবিক কারণেই এ সামাজিক প্রভেদ বা অসমতা লক্ষ করা যায়। শিশুরা বয়স্কদের কাজ যেমন করতে পারে না, তেমনি যুবকদের মতো শারীরিক পরিশ্রম করার শক্তি বৃদ্ধদের নেই। বয়সের তারতম্যের ভিত্তিতে যে অসমতা সৃষ্টি হয় তা অনেক সময়ই সমাজের কল্যাণের জন্য কাম্য ।
৩. মর্যাদাগত অসমতা : বংশধারার ভিত্তিতে মর্যাদা নির্ণীত হতে পারে। সমাজের কোনো বিশেষ বংশধারার লোকজন অন্য বংশধারার লোকজন অপেক্ষা বিশেষ উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত। অনেক আদিম সমাজেই বংশধারার তারতম্য অনুযায়ী মর্যাদার উঁচুনিচ অবস্থান নির্ণীত হয়। উৎকৃষ্ট বংশধারার লোকজন নিকৃষ্ট বংশধারার লোকজন অপেক্ষা বেশি মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী।
৪. জাতিবর্ণের ভিত্তিতে অসমতা : জাতিবর্ণ ব্যবস্থা সামাজিক অসমতার সৃষ্টি করে। জাতিবর্ণের সদস্য পদ যেহেতু জন্মের দ্বারা নির্ধারিত, অন্তর্বিবাহ যার অন্যতম রীতি তাতে জাতিবর্ণ সমাজে স্থায়ী অসমতার জন্য দায়ী। ভারতীয় এবং আফ্রিকান সমাজে জাতিবর্ণভেদে সামাজিক অসমতা দেখা যায়। ভারতীয় সমাজে ৪টি (মতান্তরে ৫টি) এবং আফ্রিকান সমাজে ৩টি জাতিতে মোট অধিবাসী বিভক্ত, যা সামাজিক অসমতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৫. নরগোষ্ঠীগত অসমতা : বর্ণবাদী নৃবিজ্ঞানীরা শ্বেতকায় নরগোষ্ঠীকে সৃজনশীল, দক্ষ, অধিক মেধার অধিকারী তথা সকল বিষয়ে উৎকৃষ্ট এবং নিগ্রো, মঙ্গোলীয় ও অস্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীকে সববিষয়ে শ্বেতকাদের তুলনায় নিকৃষ্ট বলে ঘোষণা ও প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। সামাজিক অসমতার প্রধান দিক হচ্ছে এ Race নির্দিষ্ট কতিপয় দৈহিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা Race চিহ্নিত করা হয়। এসব দৈহিক বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রে আবর্তিত হয়।
৬. শারীরিক যোগ্যতা ও চেহারা : শারীরিক যোগ্যতা এবং চেহারা সামাজিক অসমতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমন অনেক নিয়োগ ক্ষেত্র আছে যেখানে একই মানের বুদ্ধি, জ্ঞান, মেধা ও কর্মদক্ষতার অধিকারী দুজন প্রার্থীর মধ্যে যে ব্যক্তি শারীরিক দিক থেকে অধিক সুস্থ, সবল ও সুঠাম দেহের অধিকারী এবং আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী বলে বিবেচিত হয় তার নিয়োগ সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৭. বুদ্ধিবৃত্তিক পার্থক্য : বুদ্ধির মাত্রাভেদে সামাজিক অসমতা দেখা দিতে পারে এবং অনেক সময় আমরা তা লক্ষ করে থাকি। সাধারণভাবে এটি স্বীকার করা হয় যে, বুদ্ধির Genetic Component রয়েছে। জৈবিক উপাদান মূলত প্রাকৃতিক যাতে মানুষের কোনো হাত নেই। তবে উপাদানগুলো জৈবিক হলেও এর প্রতি মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি মূলত সামাজিক। কেননা, সমাজবদ্ধ মানুষই উপাদানগুলো মূল্যায়ন করে এবং এর ভিত্তিতে সমাজে অসমতা দেখা দেয়।
ii. সামাজিক উপাদান এবং সামাজিক অসমতা : নিম্নে সামাজিক অসমতার জন্য দায়ী সামাজিক উপাদানগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. শ্রেণিভেদ অসমতা : শ্রেণি হচ্ছে মুক্ত, পরিবর্তন তথা গতিশীল এক সামাজিক গোষ্ঠীর নাম। কার্ল মার্কস উৎপাদন যন্ত্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করেছেন বুর্জোয়া শ্রেণি এবং শ্রমিক শ্রেণি। যাহোক, শ্রেণিভেদে সমাজে অসমতার সৃষ্টি হয়। এটি একটা বাস্তব সত্য।
২. ক্ষমতার তারতম্যভেদে অসমতা : সামাজিক অসমতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অসম ক্ষমতা। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় যে, সম্পদের মালিকানায় সমতা প্রতিষ্ঠিত হলেও ক্ষমতা বণ্টনে সমতা আনা সম্ভব নয়। সমাজ যে পর্যায়েই অবস্থান করুক ক্ষমতা ভেদে সামাজিক অসমতা অনস্বীকার্য। তাই, বলা যায় যে, ক্ষমতা বণ্টন রীতি সামাজিক অসমতাকে প্রভাবিত করে এবং ক্ষমতাভেদে সামাজিক অসমতা সৃষ্টি করে।
৩. স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য ও অসমতা : একই পেশার লোক অথবা বিভিন্ন পেশার বা শ্রেণির লোক এক বা একাধিক উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলতে পারে। এসব সংঘে সবাই সদস্য হতে পারে না। আবার কেউ ইচ্ছা করেই যোগ দেয় না। আবার এমন কিছু সদস্য রয়েছে যারা বিশেষ সম্মানের অধিকারী।
৪. ভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীগত অসমতা : সমাজের মানুষ নানা পথ ও মতের অনুসারী। এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা সম্প্রদায়গত উন্নয়ন কাজ, আর্তের সেবা, আর্থ-রাজনৈতিক সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে আত্মত্যাগী মন নিয়ে সমাজের দুস্থ মানুষের জন্য কাজ করে। আবার অনেকে বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের উন্নয়নমূলক কাজকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করেন। কেউবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়ে সক্ষম হয়। এভাবে সমাজের বিভিন্ন সদস্য তাদের ভূমিকা ও কাজকর্মের মাধ্যমে সমাজের সবার কাছে প্রিয়পাত্র তথা মর্যাদাধিকারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। অনেকে তা পারে না। এভাবেও সমাজে অসমতার সৃষ্টি হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক অসমতা সৃষ্টির পেছনে জৈবিক এবং সামাজিক উপাদানসমূহ সক্রিয় ভূমিকা পালন করার কারণে সমাজে এখনো অসমতা পরিলক্ষিত হয়।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*