অথবা, “ঠিক হইত কী হইলে, কিন্তু গালি দূরের কথা, তাহারা নিজেরাও কি তাহা জানিত”— এ উক্তির আলোকে ‘পথ জানা নাই’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সুসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালাম বিরচিত ‘পথ জানা নাই’ একটি বিশ্লেষণধর্মী সামাজিক ছোটগল্প। এ গল্পে ভাগ্যোন্নয়নে উৎসুক গ্রামের মানুষের পথ খুঁজে না পাওয়ার বিড়ম্বনাকে চিত্রিত করা হয়েছে। মাউলতলা গ্রামের মানুষেরা জোনাবালির কথায় বিশ্বাস করে নতুন পথের আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু সে পথ তাদেরকে কিছু দেওয়ার বদলে কেড়ে নিয়েছিল অনেক বেশি।
নামকরণ : গল্পকার তাঁর গল্পের নাম দিয়েছেন ‘পথ জানা নাই’। নামকরণের ক্ষেত্রে কবি সাহিত্যিকরা কিছু নিয়ম-রীতি মেনে চলেন। এগুলোর ক্ষেত্রে লেখক গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে নামকরণের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র গহুরালি তার জীবনের পথ হারিয়ে হন্যে হয়ে মাটির তৈরি পথকে ধ্বংস করতে প্রবৃত্ত হয়েছে। এ পথ হারানো এবং পথের ঠিকানা না জানার কারণেই লেখক গল্পটির নাম দিয়েছেন ‘পথ জানা নাই’।
নামকরণের যৌক্তিকতা : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টিকর্তা তাকে মেধা, বুদ্ধি, শক্তি ও যোগ্যতা দিয়ে তৈরি করেছেন। মানুষ এসব কাজে লাগিয়ে জীবনকে উন্নত থেকে উন্নততর করে গড়ে তোলে। এই যে জীবন গড়ে তোলার সংগ্রাম, এর কোন আদি নেই কোন অন্ত নেই। এ সংগ্রাম সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে একইভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে নতুন মত, নতুন পথ আবিষ্কৃত হচ্ছে। মাউলতলা গ্রামের মানুষও নতুন পথের সন্ধানে নিয়োজিত হয়েছিল। গ্রামের বিদেশ ফেরত ধনাঢ্য জোনাবালি তাদেরকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। জোনাবালি বুঝিয়েছিল নতুন সড়ক নির্মাণ করে গ্রামকে শহরের সাথে যুক্ত করতে পারলেই জীবনের উন্নতির রাস্তা খুলে যাবে। দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে গহুরালিসহ সমস্ত গ্রামবাসী জোনাবালির কথা বিশ্বাস করে। জমি দিয়ে শ্রম দিয়ে নতুন সড়ক নির্মাণ করেছিল। কিন্তু এই সড়ক তাদের জীবনের সুখ স্বস্তি কেড়ে নিয়ে সকলকে বিভ্রান্ত করেছিল। দিশেহারা মানুষ তখন অন্য কোন পথের সন্ধান হাতড়ে পায়নি। এই যুক্তি থেকেই লেখক গল্পটির নাম দিয়েছেন ‘পথ জানা নাই’।
নামকরণের সার্থকতা : ‘পথ জানা নাই’ নামকরণটি সুন্দর ও সার্থক। মাউলতলা গ্রামের মধ্যদিয়ে নির্মিত নতুন সড়কটি গহুরালির স্ত্রীকে কেড়ে নিয়েছে। অথচ সে এই সড়কের জন্য তার পাঁচ কুড়া জমির দুই কুড়াই দিয়ে দিয়েছিল। গহুরালি ভেবেছিল এই পথ দিয়ে শহরের সাথে যোগাযোগ করে গ্রামের মানুষের জীবনে নতুন দিনের সূচনা হবে। সকলের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হবে। হতে শুরুও করেছিল। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের মানুষ গহুরালির মত ব্যবসায়বাণিজ্যে মন দিয়েছিল। কারও কারও অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছিল। কিন্তু এর সাথে সাথে গ্রামে প্রবেশ করেছিল রোগ-ব্যাধি ও মামলা-মকদ্দমা। গ্রামের শান্তিশৃঙ্খলা হয়েছিল বিপর্যস্ত। তবুও গহুরালি দমে যায়নি। উন্নত জীবনের আশায় সে শহর থেকে আসা এক দালালের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলল। নতুন জীবনের সুখস্বপ্নে যখন গহুরালি বিভোর তখন ঐ দালালের হাত ধরে তার স্ত্রী হাজেরা পালিয়ে গেল। গহুরালির সমস্ত চৈতন্যে নাড়া লেগে সে বেসামাল হয়ে পড়ল। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ঐ সড়কের উপর। তার ধারণা ঐ সড়ক তার হাজেরাকে কেড়ে নিয়েছে। গহুরালি উন্মত্তের মতো একখানা কোদাল নিয়ে সড়কের উপর গিয়ে কোপাতে শুরু করল। গ্রামের মানুষ তার পাগলামো দেখে তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করল। গহুরালি বলল, “ভুল, ভুল অইছিল এ রাস্তা বানাইন্যা। ঠিক অয় নাই।” সকলের ইচ্ছে হলো তাকে জিজ্ঞাসা করে কী হলে ঠিক ঠিক হতো। কিন্তু গহুরালি তো দূরের কথা তারা নিজেরাওতো তা জানত না। কারণ “অন্য কোন নয়া সড়কের স্বপ্নতো তাদের মনে কেহ জাগায় নাই।” তাদের কারোরই সে পথের সন্ধান জানা নেই। সুতরাং গল্পটির ‘পথ জানা নাই’ নামকরণ সুন্দর, সার্থক ও যুক্তিযুক্ত হয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষ চলার পথের, জীবনের পথের সন্ধান চায়। কিন্তু সে পথের সন্ধান জানে কয়জন । পথের সন্ধান না পাওয়ার বেদনাজর্জরিত এই গল্পের নামকরণ চমৎকার শিল্পসফল হয়েছে।
শামসুদ্দীন আবুল কালাম রচিত ‘পথ জানা নাই’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর।
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079
Leave a Reply