শামসুদ্দীন আবুল কালাম রচিত ‘পথ জানা নাই’ গল্প অনুসরণে গহুরালির চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

অথবা, “মন্বন্তরে গহুরালি নিঃস্ব হইয়াছিল বাহিরে, এবার হইল অন্তরে”— এ উক্তির আলোকে গহুরালির হৃদয়-বেদনার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘পথ জানা নাই’ গল্পে জোনাবালি হাওলাদার, গফুর আলী ওরফে গহুরালি, হাজেরা প্রমুখ কয়েকটি চরিত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তবে এ চরিত্রগুলোর মধ্যে গহুরালিই হলো প্রধান বা কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার জীবনের এক তীব্র সংকটকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে গল্পটি। তারই হৃদয় বেদনার তীব্র হাহাকার গুমরে উঠেছে গল্পটির বিস্তৃত পরিসরে। গহুরালির কথা দিয়েই শুরু হয়েছে গল্প, শেষও হয়েছে তারই খেদোক্তির বেদনাময় উচ্চারণে। বঞ্চিত জীবনের তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে গহুরালি হয়ে উঠেছে সকল পাঠকের সমবেদনার পাত্র। এই গহুরালির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ ধরা পড়ে।
মাটির গন্ধঘেঁষা মানুষ : দক্ষিণ বাংলার এক নিভৃত গ্রাম মাউলতলার অধিবাসী গফুর আলী ওরফে গহুরালি ছিল মাটির গন্ধঘেঁষা মানুষ। শিক্ষাদীক্ষা, বিত্তবৈভব কোনকিছুই তার ছিল না। বাইরের জগৎ সম্পর্কেও ছিল না তাঁর কোনরূপ স্বচ্ছ ধারণা। সামান্য পাঁচ কুড়া জমিই ছিল তার সাংসারিক আয়ের উৎস। কঠোর পরিশ্রম করে সে জমিতে ফসল ফলায়। ঐ ফসলটুকু দিয়েই কায়ক্লেশে সে তার সংসার চালায়। তাই সংগত কারণেই সে প্রথম প্রথম জোনাবালি হাওলাদারের সড়ক নির্মাণ প্রয়াসের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। কেননা পরিকল্পিত সড়ক তাঁর পাঁচ কুড়া জমির দুই কুড়ার উপর দিয়ে চলে গেছে। সড়কের জন্য ঐ জমিটুকু ছেড়ে দিলে তাকে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়তে হবে। তাই সে প্রশ্ন উত্থাপন করে “মোডে পাঁচ কুড়া ভুঁই আমার । হের দুই কুড়াই সড়কে খাইলে আমি খামু কী?” গহুরালির এই প্রশ্নে তার যে আর্থিক সংগতি ও অসহায়তার পরিচয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা তাকে চিহ্নিত করেছে মাটির কাছাকাছি অবস্থিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে।
সরল : মাটির কাছাকাছি অবস্থানরত মানুষ হবার কারণেই গহুরালির চরিত্রে কোন জটিলতা নেই। শিশুর সারল্য দিয়ে গড়া
তার মন। রাস্তার জন্য জমি দান করলে তার অনাহারে থাকার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি জোনাবালি
হাওলাদার যখন তাকে জমি দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়, তখন সে একান্ত সরল বিশ্বাসে তার
জমিটুকু সড়কের জন্য দিয়ে দেয়।বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন বউ হাজেরার আপত্তিকে সে অগ্রাহ্য করে এই যুক্তি দেখিয়ে— ‘অতোশতো ভাবতে গেলে কি আর দেশের দশের কাজ হয়?’ কোনকিছু গভীরভাবে ভেবে দেখার মত তীক্ষ্ণবুদ্ধি তার ছিল না। তাই জীবনের ঘাটে ঘাটে তাকে প্রতারিত হতে হয়েছে। পরিণত হতে হয়েছে এক পোড় খাওয়া মানুষে। কিন্তু চরম মুল্যের বিনিময়েও সে আঁকড়ে ধরে থেকেছে তার সারল্যকে।
বাহিরে অন্তরে নিঃস্ব : আপন অন্তরে শুভ্র স্বপ্নের জাল বুনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে গহুরালি অগ্রসর হলেও শেষাবধি চরম ব্যর্থতা ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি। যে মানুষটি হয়ে উঠতে পারত এক সফল জীবনের অধিকারী, শেষাবধি একজন বিধ্বস্ত ও পোড়া মানুষ ছাড়া সে আর কিছুই হতে পারেনি। আর্থিক সমৃদ্ধিকে সে যেমন করায়ত্ত করতে পারেনি, তেমনি পারেনি অন্তরের প্রশান্তিটুকু জিইয়ে রাখতে। সবকিছু হারিয়ে সে হয়ে উঠেছে এক সর্বস্বান্ত ও রিক্ত মানুষের যথার্থ প্রতিনিধি ।
মন্বন্তর : সড়ক তৈরির আগে পাঁচ কুড়া জমির মালিক গহুরালি এই জোত জমি থেকেই তার যাবতীয় প্রয়োজন মেটাত। প্রাচুর্য তার জীবন ও সংসারে ছিল না। কিন্তু কোন দুঃসহ অভাবের কাছেও তা থমকে বা দাঁড়িয়ে ছিল না। সড়ক তৈরির পর প্রায় আমূলভাবেই বদলে গেল তার জীবনের চালচিত্র। সড়ক যোগাযোগের প্রথম দিকে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল তার জীবনে। হাতে জমেছিল কিছু কাঁচা পয়সা। তা দিয়ে সে খড়ের চাল বদলে টিনের চাল লাগিয়েছিল ঘরে। কিন্তু সে সুদিন তার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। যে সড়কপথে শহরে যাতায়াত করে সে খানিকটা বাড়তি রোজগারের সুযোগ পেয়েছিল, সেই সড়কপথেই শহর থেকে গ্রামে এসে পৌঁছে যুদ্ধের উত্তাপ ও মন্বন্তরের পদধ্বনি। হু হু করে বেড়ে যায় জিনিসপত্রের দাম। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অন্নবস্ত্রের অভাব দেখা দেয় সর্বত্র। এই দুর্দিনে গহুরালির সুখ, স্বস্তি ও সমৃদ্ধির সবটুকুই নিঃশেষ হয়ে যায়। দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধের আগুনে পুড়ে যায় তার জীবনযাপনের শান্তি আর আনন্দ। সে নিঃস্ব হয়ে পড়ে বাইরে থেকে।
রক্ষক্ষরণ : তবে শুধু বাইরেই নয়, হৃদয়ের নিভৃত অন্তঃপুরেও শুরু হয় তার এক মর্মান্তিক রক্তক্ষরণ। অভাবজনিত দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সে হাত মিলিয়েছিল শহর থেকে আসা দালালের সাথে। শহুরে দালাল এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল গহুরালির স্ত্রী হাজেরাকে প্রলুব্ধ ও করায়ত্ত করে। ফলে কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে সে কোথাও আর তার বউকে খুঁজে পায় না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারে যে শহুরে দালালের সঙ্গে তার বউ চলে গেছে শহরের দিকে। ফলে এক সীমাহীন শূন্যতার ভারে নুয়ে পড়ে গহুরালি। ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও তার সান্ত্বনার কোন আশ্রয় থাকে না। সবদিক থেকেই সে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এ অসহায়ত্ব ও অবরুদ্ধ আক্রোশ নিয়ে সে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে থাকে নতুন সড়কটিকে। কেননা তার জীবনের সব বিপর্যয়ই এসেছে এই সড়কপথ ধরে। তাই সড়কের উপরই ঝরে পড়ে তার সবটুকু আক্রোশ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সারল্য, শ্রমনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, উচ্চাভিলাষ, দারিদ্র্য, প্রেম ও বঞ্চনার সমভিব্যাহারে গড়ে উঠেছে গহুরালির চরিত্র। তার সারল্য ও সাফল্য পাঠককে আনন্দ দেয়। আর বঞ্চনা ছড়ায় বিষণ্নতার বেদনা। সব মিলিয়ে গহুরালি গল্পকারের এক সার্থক সৃষ্টি।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*