লালন শাহের দর্শনকে মরমী দর্শন বলা হয় কেন?

অথবা, লালন শাহের দর্শনকে মরমীদর্শন বলা যায় কী না?
অথবা, লালন শাহের দর্শন কী মরমী দর্শন?
অথবা, লালন শাহের দর্শনকে মরমী দর্শন বলার কারণ কী?
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। বুদ্ধিবৃত্তির স্বাভাবিক আকর্ষণেই মানুষ জানতে চায় অজানাকে উন্মোচন করতে চায় তার সৃষ্টিও বৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর অপার রহস্যকে। জানতে বা উপলব্ধি করতে কিংবা একাত্ম বা মিলিত হতে চায় সেই পরম সত্তার সাথে যিনি সৃষ্টি করেছেন এ জগৎ সংসারকে কিন্তু এ উপলব্ধি বা মিলনের উপায় কি? এ প্রশ্নে সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে চিন্তাশীল মানুষের সুসংগঠিত চিন্তার ফসল হিসেবে যে সকল তত্ত্ব বা মতবাদের উদ্ভব হয়েছে তন্মধ্যে মরমিবাদ অন্যতম। এই মতবাদে ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা বিচারবুদ্ধি নয়, বরং মরমি অভিজ্ঞতা বা স্বজ্ঞার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় জগৎ, জীবন ও পরমসত্তাকে। এর জন্য দরকার কঠোর, কঠিন ও গভীর অনুশীলন বা সাধনার। বাঙালির জগৎজীবন ভাবনা বা দর্শন চিন্তায় এ মরমিবাদ একটি বিশেষ স্থান লাভ করে আছে।
লালন শাহের মরমি দর্শন : বাংলার মরমি সাধক ও বাউলকুল শিরোমণি লালন শাহের জন্ম আনুমানিক ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে। বাউল ও বাউল দর্শন বলতে আমরা মূলত লালনের জীবনসাধনা ও গানকেই বুঝি। লালন লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে তাঁর জীবনব্যাপ্ত সাধনা দিয়ে বাউল দর্শনের ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবি ও মরমি দর্শন চিন্তাবিদ । তিনি তাঁর কবি মন দিয়ে দেহতত্ত্ব আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ইত্যাদি জটিল ভাবের গান গেয়ে তাঁর মরমি দর্শন চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন। আমরা জানি আপন হৃদয়ে পরমসত্তাকে অপরোক্ষ অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করার সাধনাই মরমি সাধনা। লালন তাঁর সমগ্র জীবন কর্ম ও গানে এ উপলব্ধিই করতে চেয়েছেন সর্বাত্মকরণে। লালন তাঁর মরমি চিন্তায় মনের মানুষকে (পরম সত্তাকে) খুঁজে ফিরেছেন এবং সে পথ পরিক্রমায় তিনি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তবুও তিনি পথ পাড়ি দিচ্ছেন। মনের মানুষ তথা পরমসত্তার সাথে মিলিত হবার একাত্ম হবার এই যে আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা লালনের দর্শনে প্রকাশ পায় তাই তাঁর মরমি আদর্শকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। লালনের দর্শনে মরমিবাদের সুস্পষ্ট প্রকাশ আমরা দেখতে পায় আত্মতত্ত্বে। লালন তাঁর আত্মতত্ত্বে মানবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোন পার্থক্য করেন নি। তাঁর মতে মানুষের এসেন্স বা অন্তঃসার তার দেহেই নিহিত। তাই দেহের সাধনার মধ্য দিয়েই পরমাত্মার সাধনা করা যায়। দেহের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় পরম স্রষ্টাকে। তাইতো লালন আত্মতত্ত্বের সাধনায় মগ্ন থেকেছেন আজীবন। এ কারণেই তিনি বলেছেন মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে সে কি তত্ত্ব মানে লালন মানবসত্তার মূল তত্ত্বে যাবার প্রেরণাও পেয়েছেন আত্মতত্ত্ব থেকেই। তিনি পার্থিব মানব অভ্যন্তরে কথাই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচিত গানের নিম্নোক্ত দুটি লাইনে
“এই মানুষেই আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন।”
এই মানুষ রতন বা পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনের প্রচেষ্টাই লালনের হৃদয়ানুভূতিকে ব্যাকুল করে তুলেছিল। কেননা তিনি বিশ্বাস করেতেন এ মনের মানুষকে জানলেই নিজকে জানা যায়। পরমসত্তা বা পরম পুরুষকে জানা যায় কিন্তু একে জানা সহজ নয়। তাকে ধরতে গেলে সে ধরা দেয় না তাইতো লালন একে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন অন্তরের আলোকে অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় স্বাজ্ঞিক বা মরমি অভিজ্ঞতার আলোকে। আর এখানেই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে লালনের মরমি চিন্তাদর্শের মূলসূর।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় মরমি মতাদর্শ বাঙালির ধর্ম দর্শন ও সাহিত্য চিন্তার এক অপরিহার্য অঙ্গ। সহজ, খোদাভীরু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বাঙালির চারণভূমিতে মরমি আদর্শের বপিত বীজ সেনার ফসল ফলিয়েছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচীনকালে বাঙালির মননে আধ্যাত্মিকতা বা মরমি আদর্শের যে স্ফূরণ ঘটে তাই কালক্রমে এদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে। বিশেষ করে মধ্যযুগে বৈষ্ণববাদ, সুফিবাদ ও বাউলবাদের হাত ধরে বাংলায় এই মতাদর্শের চরম ও পরম বিকাশ ঘটে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-2/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*