রাজবন্দীর জবানবন্দী” প্ৰবন্ধ অনুসরণে কাজী নজরুল ইসলামের আত্মচেতনার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলামের আত্মচেতনার যে প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় আলোচনা কর।
অথবা, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধের আলোকে কাজী নজরুল ইসলামের আত্ম-উপলব্ধির পরিচয়
উত্তর৷ ভূমিকা :
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় একটি সরকার বিরোধী নিবন্ধ প্রকাশ করার অপরাধে কবিকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। এ মামলার শুনানি চলাকালে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি কবি আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে লিখিত বক্তব্য প্রদান চেতনা ও করেছিলেন তা-ই “রাজবন্দীর জবানবন্দী” শিরোনামে প্রবন্ধ হিসেবে গ্রন্থিত হয়েছে। প্রবন্ধটিতে আত্মোপলব্ধির মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে।
রাজবন্দী কবি : দেশ তখন পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতবাসীর সকল প্রকার ব্যক্তিগত ও গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো ভারতবর্ষের বুকে চেপে বসেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে কাজী নজরুল ইসলাম দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরলেন। বিদ্রোহাত্মক কবিতা ও গান রচনা করে তিনি ভারতবাসীকে জাগিয়ে তোলার মহান ব্রতে ব্রতী হলেন। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনা করে তিনি এ বিদ্রোহের বাণী প্রচার করছিলেন। শাসকগোষ্ঠী ‘ধূমকেতু’ ও এর সম্পাদকের উপর ক্ষিপ্ত হলো। সরকারবিরোধী লেখা প্রকাশের দায়ে কবির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করে কারাগারে নিক্ষেপ করলো ব্রিটিশ সরকার। কবি হলেন রাজবন্দী।
কারাগারে নজরুল : কলকাতার প্রেসিডেন্সি কারাগারে বন্দী থাকাকালীন প্রাবন্ধিক কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী চেতনার কিছুমাত্র ব্যত্যয় ঘটল না। কারানির্যাতনের কষ্টিপাথরে বরঞ্চ তা আরো শানিত হয়ে উঠল। কারাগারে বসেই কবি বিদ্রোহাত্মক কবিতা ও গান লিখে চললেন। তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হলোঃ


“লাথি মার ভাঙরে তালা
যত সব বন্দীশালা
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি।”


রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার শুনানিকালে কবি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জ্বালাময়ী বক্তব্য আদালতে পেশ করলেন। সে বক্তব্যই “রাজবন্দীর জবানবন্দী।”
দুঃসাহসী নজরুল : রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কারান্তরীণ হওয়ার পরও বিদ্রোহী কবির মনমানসিকতার কোন পরিবর্তন লক্ষ করা গেল না। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে তিনি বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করলেন। চরম দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন করে তিনি ব্রিটিশ আদালতের বিচারকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। তিনি দাবি করলেন, “বিচারক জানে আমি যা বলেছি, যা লিখেছি তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু তবু হয়তো সে শাস্তি দিবে, কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে অন্যায়ের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য।” এভাবেই নজরুল ব্রিটিশ বিচার-ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি। দেখিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ রাজ সম্পর্কে মূল্যায়ন : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ রাজকে অত্যাচারী দখলদার শক্তি বলে মনে করতেন। তাই তাদের আইন-আদালত ও বিচারব্যবস্থাকে তিনি পরোয়া করতেন না। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের বাণী যাকে ব্রিটিশরাজ রাজদ্রোহ বলে অভিযুক্ত করেছিল তাকে কবি ‘ভগবানের বাণী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমার বাণী সত্যের প্রবেশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে। কিন্তু ন্যায় বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজবিচারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বান সত্যস্বরূপ।” এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কবির ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার সম্যক পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে।
সত্য স্বয়ং প্রকাশ : কাজী নজরুল ছিলেন সত্যের পূজারী। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি আপসহীন আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি জানতেন ‘সত্য স্বয়ং প্রকাশ’। তাকে কোন প্রবল প্রতাপশালী রাজশক্তি মিথ্যার আবরণে ঢেকে রাখতে পারবে না। সত্যকে কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে সক্ষম হবে না। কবি সে চিরন্তন স্বয়ং প্রকাশের বীণা হাতে যুদ্ধে নেমেছিলেন। তিনি নিজেকে ভগবানের হাতের বীণা বলে দাবি করেছেন। কবি জানতেন, একথা ধ্রুব সত্য যে, সত্য আছে ভগবান আছেন। সত্য ও ভগবান চিরকাল ধরে আছে। চিরকাল ধরে থাকবে। যারা ভগবানকে উপেক্ষা করে সত্যকে বিনাশ করতে চায় তাদের অহঙ্কার একদিন চোখের জলে ডুববেই। কারণ সত্য ও ভগবান নিত্য ও অবিনশ্বর।
কবির আত্মোপলব্ধি : কবি দেখেছিলেন, পরাধীন ভারতবর্ষে অন্যায়কে অন্যায় বললে ইংরেজের কাছে তা হয় রাজদ্রোহ। জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো কোন ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এ শাসন কোন দিন চিরস্থায়ী হবে না। সত্য আজ জেগে উঠেছে। এ অন্যায় শাসনক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন কবির কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই তিনি রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কবি মনে করতেন, তাঁর কণ্ঠের ওই প্রলয় হুঙ্কার কেবল তাঁর একার নয়, তা নিখিল বন্দী আত্মার যন্ত্রণাচিৎকার । হাজারো ভয় দেখিয়ে এ ক্রন্দন থামানো যাবে না। এ আত্মোপলব্ধি অন্তরীণ কবিকে সাহস ও ক্ষমতা জুগিয়েছিল ।
কবির আত্মচেতনার স্বরূপ : কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ কবি আত্মচেতনার শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন। তিনি ছিলেন পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই যাকে তিনি অন্যায় বলে বুঝেছেন তাকে অন্যায় বলেছেন, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছেন। তিনি কাউকে তোষামোদ করেননি, প্রশংসা ও প্রসাদের লোভে কারও পো ধরেননি। তিনি কেবল রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেননি; সমাজ, জাতি ও দেশের সকল প্রকার অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তাঁর কণ্ঠ। বিদ্রূপ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত অপরিমেয় পরিমাণে বর্ষিত হলেও কোনো কিছুর ভয়ে তিনি পিছপা হননি। লোভের বশবর্তী হয়ে আত্মচেতনাকে তিনি কারো কাছে বিক্রি করেননি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, কবি নিজের আত্মাকে সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা বলে দাবি করেছেন। তিনি অজানা অসীম পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটি তাঁর অহঙ্কার নয়- এটি ছিল আত্মোপলব্ধির আত্মবিশ্বাসের চেতনালব্ধ সহজসত্যের সরল স্বীকারোক্তি। তিনি অন্ধবিশ্বাসে লোভের বশবর্তী হয়ে রাজভয় বা লোক ভয়ে মিথ্যাকে অত্যাচারকে মেনে নিতে পারেননি । তিনি নিজেকে ভয়হীন, দুঃখহীন এক অমৃত্যের পুত্র বলে দাবি করেছেন। এ দাবিই কবির আত্মচেতনার স্বরূপ নির্ধারক।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*