মোহাম্মদ বরকতুলাহ কে ছিলেন? মোহাম্মদ বরকতুলাহর জীবনদর্শন আলোচনা কর।

অথবা, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর পরিচয় দাও। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর দর্শন চিন্তা বিস্তারিত বিবরণ দাও।
অথবা, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর পরিচয় দাও। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর দর্শন ভাবনা বিস্তারিত বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
যে প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে এ সময় পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে তাই বাংলাদেশ দর্শন। আর এ বাংলাদেশ দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাদের নাম অগ্রগণ্য, তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ অন্যতম। তিনি তাঁর নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত দার্শনিক মতের দ্বারা বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে বিশিষ্ট দার্শনিকের মর্যাদা পেয়েছেন।
মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর পরিচয় : বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও দার্শনিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলো :
জন্ম ও শিক্ষাজীবন : মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন পাবনা জেলার শাহজাদপুরে ১৮৯৮ সালের ২ মার্চ। তাঁর পিতার নাম ছিল হাজী আজম আলী। তিনি ১৯১৪ সালে শাহজাদপুর হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯১৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই. এ পাস করেন। ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে অনার্সসহ বি. এ পাস করেন। ১৯২০ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এম. এ পাস করেন। ১৯২২ সালে আইন পরীক্ষায়ও তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
কর্মজীবন : মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ ১৯২৩ সালে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস (Bengal Civil Service) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে সরকারের আয়কর অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ক্রমান্বয়ে তিনি ১৯২৪ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ১৯৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট এবং ১৯৩৬ সালে সাব-ডিভিশনাল অফিসার পদে পদোন্নতি লাভ করেন।এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য সিভিল সাপ্লাই বিভাগে চাকরি করেন। ভারত বিভক্তির পর তিনি ফরিদপুর,কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পদোন্নতি পেয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি (১৯৫১-১৯৫৫) হিসেবে নিযুক্ত হন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৯৫৫-৫৭ পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমীর বিশেষ কর্মকর্তা (পরিচালক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রচনাবলি : মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ তাঁর কর্মময় জীবনে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ উল্লেখ করা হলো : পারস্য প্রতিভা (১ম খণ্ড, ১৯২৪; ২য় খণ্ড, ১৯৩২), মানুষের ধর্ম (১৯৩৪), কারবালা ও ইমাম বংশের ইতিবৃত্ত (১৯৫৭), নয়া জাতির স্রষ্টা হযরত মুহম্মদ (স) (১৯৬৩), বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ধারা (১৯৬১) ইত্যাদি।
মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর জীবনদর্শন : লেখক ও চিন্তাবিদ হিসেবে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর খ্যাতি সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মানুষের ধর্ম’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশের পর। নিম্নে তাঁর জীবনদর্শনের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো :
১. আত্মা সম্পর্কিত মত : আত্মপ্রতিষ্ঠাকে বরকতুল্লাহ ঘোষণা করেছেন তাঁর দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য হিসেবে। তাঁর মতে, আত্মপ্রতিষ্ঠা জগতের এক স্বাভাবিক ও চিরন্তন ধর্ম। অচেতন জড়বস্তু থেকে শুরু করে সচেতন জীব পর্যন্ত সর্বত্র লক্ষ্য করা যায় এ স্বাভাবিক ধর্মের অভিব্যক্তি। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অধিকতর বিস্তৃত জীবজগতে। জীব বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট হয় না, নিজেকে প্রসারিত করতে চায় কালের প্রবাহে, অমরত্ব অর্জন করতে চায় সুকৃতি ও সন্তানসন্ততির মাধ্যমে। প্রাণিজগতের অন্যান্য সদস্য ও মানুষের মধ্যে এ এক অভিন্নভাবে উপস্থিত থাকলেও মানুষ অর্জন করেছে এক বিশেষ শক্তি। এ শক্তির নাম আত্মা। আত্মাও অমরত্বে অভিলাষী। প্রকৃতি জগতে ও জীবজগতে বিবর্তন যেমন অবিরত অগ্রসরমান, আত্মাও তেমনি তার নিজস্ব জগতে বেঁচে থাকবে, আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে- এটাই তার আশা ও বিশ্বাস। এ বিশ্বাস থেকেই মানুষ রচনা করেছে পরলোকে তার বাসস্থান সম্পর্কে এক চমৎকার চিত্র, কল্পনা করেছে প্রাসাদোপম অট্টালিকা, মনোরম উদ্যান ও স্রোতস্বিনী সংবলিত স্বর্গীয় পরিবেশের কথা।
২. জ্ঞান লাভের উপায় : বহির্জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের বাহন মানুষের ইন্দ্রিয়। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সবকিছু জানা যায় না। জ্ঞানার্জনে বুদ্ধিবৃত্তির ভূমিকা কোনমতেই উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু মানবজীবন ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিবৃত্তির যোগফলই নয়, তার চেয়ে বৃহত্তর একটা সত্তা, এমন সত্তা যা গঠিত বুদ্ধিবৃত্তি এবং আরো অনেক কিছু নিয়ে। বুদ্ধি ছাড়াও তাই স্বীকার করতে হয় প্রবৃত্তি (Instinct) ও স্বজ্ঞা (Intuition) নামক জ্ঞানের অন্যান্য বাহনকে। স্বজ্ঞাকে বর্ণনা করা যায় অতীন্দ্রিয় অনুভবশক্তি বলে। এ ধরনের একটি শক্তি যে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত এবং তা যে উচ্চতর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের একটি অনিবার্য ও ফলপ্রসূ বাহন তা সন্দেহ করার কারণ নেই। এ উচ্চতর জ্ঞানশক্তির উপস্থিতির কারণেই সসীম মানুষ প্রয়াসী হয় তার মধ্যে অসীমকে খুঁজে পাওয়ায়, আদর্শকে বাস্তবায়িত করায়। তাইতো বাস্তবকে অতিক্রম করে আদর্শ অর্জনের জন্য মানুষের এতো প্রচেষ্টা। এক আদর্শ অর্জনের পর মানুষ শুরু করে তার চেয়েও উচ্চতর আরো নতুন কিছু আদর্শ অর্জনের । পরলোক কিংবা স্রষ্টার ব্যাপারে কৌতূহল মানুষের এ প্রেরণারই বহিঃপ্রকাশ।
৩. পরমাত্ম : জ্ঞান ও সত্যের প্রকৃত সাধক গভীর মনোযোগ দ্বারা প্রগাঢ় অন্তর্দৃষ্টি অর্জনে সক্ষম। তাইতো ভাবুক সাধকরা হরিণের ন্যায় বাহ্যজগতে কস্তুরীর সন্ধান করেন না, বরং নিজের অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করেন চরম ও পরমসত্তাকে। সাধনায় সত্যিকার অর্থে যারা এক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভ দ্বারা পরম চেতনার সন্ধান পেয়েছেন, মরণ তাদের স্পর্শ করতে পারে না। জড় দেহ বিনষ্ট হলেও তাঁদের আত্মা অমর, অবিনশ্বর। সমগ্র বিশ্বচরাচর জুড়ে প্রবহমান রয়েছে একটি প্রেরণা, একটি সচেতন অভিব্যক্তি।জড় বস্তুর চেতনা নেই কিন্তু এর যে প্রেরণা, তা শুধু সচেতনই নয়, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুচালিত। ফলে এর পিছনে যে একজন চালক ও নিয়ন্ত্রক আছেন, তা নিশ্চিত বুঝা যায়। মানুষ এ প্রেরণার এবং বিবর্তনধারার বাইরে নয়। মানুষের ধর্ম তার সসীম গণ্ডি অতিক্রম করে অসীমের সাথে একাত্ম হওয়া। শাশ্বত সত্যে মানুষের সাথে এই যে একাত্মতার অনুভূতি তাতেই সার্থকতা।
আত্মা নিজেকে সর্বতোভাবে আত্মস্থ মনে করে একমাত্র সনাতন পরমার্থে।
৪. নীতিবোধ : ন্যায়, সুনীতি, কল্যাণ, সৌন্দর্য প্রভৃতি মানবজীবনের তাৎপর্যপূর্ণ ঐশ্বর্যস্বরূপ। এগুলোর স্বীকৃতি ও লালনেই নিহিত মানুষের স্বকীয়তা ও মহত্ত্ব। যে ন্যায়শাস্ত্র এ সনাতন মূল্যবোধকে অস্বীকার করে, তার ব্যবস্থা মানবসমাজে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, বরং সূত্রপাত করে বিপদ ও প্রলয়ের। আপন অধিকারবোধ এবং অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। ন্যায় ও সুনীতির ধারাকে যিনি সশ্রদ্ধচিত্তে মান্য করে চলেছেন, তিনি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে জামাত দেখেন পরম নিত্য সত্য ও সত্তাকে। তাঁর পক্ষেই সম্ভব মানুষকে প্রকৃত মানুষরূপে শনাক্ত করা। এ জাতীয় মানুষ যথার্থই উপলব্ধি করেন, তাঁরা স্বাধীন; অপরের স্বাধীনতাকে হরণ বা অতিক্রম করে নয় বরং এক বৃহত্তর স্বাধীন সত্তার অংশ হিসেবে। তাঁদের স্বাধীনতা ও সার্থকতা সংকীর্ণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পরিব্যাপ্ত ও পরিস্ফুট সবার মধ্যে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ তাঁর ব্যস্ততম কর্মময় জীবনে শুধু আত্মস্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুখভোগে ব্যাপৃত না থেকে দেশ ও জনগণের কল্যাণে তাঁর সুচিন্তিত মতামত লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাঁর জীবনে তিনি যে দার্শনিক মতের উপর আস্থাশীল ছিলেন তা হচ্ছে স্বজ্ঞা। তবে তিনি জানাডের ক্ষেত্রে বুদ্ধিকে একেবারে ফেলে দেননি এবং বিজ্ঞানকে অকার্যকর বলেননি। আর এ মহামূল্যবান মতের জন্য তিনি বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%85%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%a6-%e0%a6%ac/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*