বেগম রোকেয়ার উপর একটি প্রবন্ধ রচনা কর।

অথবা, বেগম রোকেয়ার জীবন দর্শন আলোচনা কর।
অথবা, বেগম রোকেয়ার পরিচিতি প্রদানপূর্বক তাঁর মানস প্রকৃতি ও অবদান আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দার্শনিক হিসেবে বেগম রোকেয়া একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব-আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বাঙালি মুসলিম সমাজের নানা কুসংস্কার ও অবরোধের বিরুদ্ধে যে কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে বেগম রোকেয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর মত প্রতিভাবান ব্যক্তি তৎকালীন সমাজে তথ্য বর্তমান সমাজে অপ্রতুল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যেখানে মুসলমান সমাজের মেয়েদের পরিবার এমন কি পরিবারের সদস্যদের সামনে ঘোরাফেরা করা নিন্দনীয় ছিল, তেমনই এক সময় তাঁর জীবন ও কর্মে প্রতিধ্বনিত হয়েছে জাগরণের গান। পাঁচ বছর বয়সে যেখানে পর্দা করতে হয়েছে সেখানে অবরোধবাসীনী হিসেবে নিজেকে তিনি আবদ্ধ রাখতে চাননি। নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সম্মানজনক আসনে।
বেগম রোকেয়ার পরিচয় : বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবার। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম রোকেয়া খাতুন। সাধারণের কাছে তিনি বেগম রোকেয়া নামে পরিচিত। বিবাহের পর স্বামীর নামের সাথে নাম মিলিয়ে তাঁর নাম হয় মিসেস রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। লেখক হিসেবে তাঁর নাম মিসেস আর. এস. হোসেন। বেগম রোকেয়ার পিতার নাম জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের এবং মাতার নাম রাহাতুন্নেসা সাবের চৌধুরাণী। বেগম রোকেয়ার দুই ভাই এবং তিনি ছাড়া আরও দুই বোন ছিল। মাত্র ষোলো বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
বেগম রোকেয়ার লেখাপড়া : রেগম রোকেয়ার প্রাথমিক জ্ঞান হয় পরিবারেই। তিনি বড়বোন করিমুন্নেসার কাছে বাংলা ও ইংরেজি বর্ণ পরিচয় শেখেন। বাবা নারী শিক্ষার বিরোধী হওয়ায় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। বেগম রোকেয়ার আগ্রহে বড় ভাই আবুল আসাদ ইব্রাহীম সাবেরের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। বিয়ের পর সমাজ সচেতন, সংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের সংস্পর্শে তাঁর প্রকৃত লেখাপড়া শুরু হয়। তিনি দেশি- বিদেশি লেখকদের বিভিন্ন গ্রন্থের সাথে পরিচিত হন এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় পরিপক্কতা অর্জন করতে থাকেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন ইংরেজি বই পাঠ করেন এবং সাহিত্য চর্চা করতে থাকেন।
বেগম রোকেয়ার মানস সংস্কৃতি : বেগম রোকেয়ার মন-মানসিকতা ছিল আধুনিক। তিনি যুগের চেয়ে চিন্তায় ছিলেন অগ্রগামী। তাঁর চিন্তাভাবনার সম্প্রসারিত দিক হলো বর্তমানের নারী জাগরণমূলক না নারীর অধিকার আন্দোলনের ভিত্তি। তাঁর মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদীতা, ইহজাগতিক বা বস্তুবাদী চিন্তা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, মানবতা প্রভৃতির সন্নিবেশ ঘটেছিল। তাঁর চিন্তা তাঁর কর্মের মধ্যে প্রতিফলিত।
নারীমুক্তি আন্দোলন : সমাজে নারীর অবস্থান ও তাদের দুর্দশার করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি নারীমুক্তির জন্য আন্দোলন করেন। তাঁর নারীমুক্তির মূল কথা হলো সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ। তাঁর নারী মুক্তির দর্শন, সাহিত্য ও কর্মজীবনের নানা সংস্কারমূলক কার্যাবলির মধ্যে ফুটে উঠেছে। তিনি পুরুষতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং প্রচলিত ধর্মীয় গোঁড়ামিকে কটাক্ষ করে নারী শিক্ষা সম্প্রসারণ করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁরই অর্থ ও পরিকল্পনা অনুসারে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নামে একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
সমাজসংস্কারমূলক কর্মসূচি : বেগম রোকেয়ার জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি নারীর জাগরণ এবং প্রচলিত সমাজের সংস্কার। তিনি শুধু সাহিত্য রচনা নয় বাস্তব জীবনে সংস্কার সাধনের চেষ্টা করেন। এ জন্য তিনি দুটি লক্ষ্য স্থির করেন। যথা :
১. নারীশিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা করা।
২. অবরোধ প্রথার অবসান।
তিনি নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়েছেন এবং নারীর আত্মবোধের উন্মেষ সাধন করতে সহায়তা করেছেন।বেগম রোকেয়া মনে করতেন বাঙালি মুসলিম নারীকে শিক্ষিত করার অর্থই পুরো সমাজকে জাগ্রত করা।
মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা : ১৯১৫ সালে বেগম রোকেয়া আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি গঠন করেন। তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডে এ সমিতির বিশেষ ভূমিকা ছিল। এ সমিতির মুসলিম নারী সমাজকে সচেতন করা, তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করা প্রভৃতি উদ্দেশ্যে কাজ করে। এছাড়াও নানা ধরনের সেবামূলক কাজও করে এ সমিতি। যেমন-
১. বিধবা ও অসহায় নারীদের অর্থ সাহায্য দেওয়া।
২. বয়ঃপ্রাপ্ত দরদ কুমারী নারীদের বিবাহ দান।
৩. অভাবী বালিকাদের শিক্ষা লাভে অর্থ সাহায্য করা।
৪. মহিলাদের পুনর্বাসন করা প্রভৃতি।
এ সমিতি মুসলিম মহিলা সমাজের জন্য নিরলসভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে কাজ করেছে। তৎকালীন সমাজে মুসলমান নারী সমিতি গঠন ও পরিচালনা করেছে তা ছিল কল্পনার বাইরে।
সাহিত্যকর্ম : বেগম রোকেয়া তাঁর জীবদ্দশায় অনেকগুলো প্রবন্ধ ও গল্প রচনা করেছেন। তাঁর পাঁচটি গ্রন্হ রয়েছে।যথ-
১. মতিচুর ১ম খণ্ড (১৯০৪)
২. পরাগ (১৯২৪)
৩. Sultana’s Dream (1908)
৪. মতিচুল ২য় খণ্ড (১৯২২)
৫. অবরোধবাসিনী (১৯৩১)
এছাড়া তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা সাধনা, ধুমকেতু, বার্ষিক সওগতি, নওরোজ, মোহাম্মদী, সাহিত্যিক, সবুজপত্র, মোয়াজ্জিন, The Mussalmans, মাহে নও প্রভৃতি পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা প্রকাশ করেন। তিনি ইংরেজিতে অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখা অনেক প্রবন্ধ আজও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। তিনি বাঙালি সাহিত্য সাধনায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে স্থান দখল করে আছেন।
নারীবাদ ও তাঁর অবস্থান : বেগম রোকেয়াকে অনেকে নারীবাদী বলেন, আবার অনেকে তাকে নারীক্ষমতা উন্নয়নের অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করেন। হুমায়ুন আজাদ বেগম রোকেয়াকে নারীবাদী হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির দর্শন ‘নারীবাদ’ এবং নারীমুক্তির আন্দোলন তাঁর ভাবমূর্তি নারীবাদী। তাঁর সমস্ত সাহিত্যে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ। বেবী মওদুদ ও বাংলাদেশের নারীগ্রন্থে বেগম রোকেয়াকে নারীবাদী বলে অভিহিত করেছেন। তবে অনেকে মনে করেন বেগম রোকেয়া প্রচলিত যৌনাশ্রয়ী নারীবাদীদের মত নন। সমাজের বাস্তবতাকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন। ফলে তাঁর মধ্যে পুরুষ বিদ্বেষী ভাব জাগ্রত। তিনি অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের সহায়তা ও সহমর্মিতাও স্বীকার করেন। তাই চূড়ান্ত অর্থে তাঁকে নারীবাদী না বলে নারী উন্নয়নের অগ্রদূত বা নারী ক্ষমতায়নের একনিষ্ঠ সাধক ও কর্মী হিসেবে গ্রহণ করেন। মূলত বেগম রোকেয়া বর্তমানে সমাজে প্রচলিত নারীবাদী অর্থে নারীবাদী নন। তিনি বিশুদ্ধ নারীবাদের সমর্থক এটা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, কথায়, কাজে, চিন্তায় এবং বাস্তব জীবনে যে কয়েকজন বাঙালি দার্শনিক বিশেষ অবদান রেখেছেন বেগম রোকেয়া তাদের মধ্যে কর্মের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত। তাঁর জীবন ও সাহিত্য কর্ম অনুসন্ধান যুক্তিবাদী বিজ্ঞানসম্মত বেগম রোকেয়াকে অন্যতম। বেগম রোকেয়ার দর্শন চিন্তা, তাঁর জীবন ও করলে আমরা দৃঢ়চেতা, সংস্কারমুক্ত, দেখতে পায়। বাঙালি নারীশিক্ষার যে সূচনা তিনি করেছিলেন ফল বর্তমান নারীশিক্ষা ব্যবস্হায় নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ।তিনি ভ্রমণ করেছিলেন দ্বারে দ্বারে আর বর্তমান নারী তারই সূত্র ধরে ভ্রমণ করেছে আকাশে। এই মহীয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর পরলোকে গমন করেন। পিছনে রেখে যান কর্মময় নারীর মুক্তির দর্শন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%97%e0%a6%ae-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*