বাঙালি দার্শনিক ড গোবিন্দ চন্দ্র দেবের সমন্বয়ী দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত লিখ ।

অথবা, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে কি একজন সমন্বয়বাদী দার্শনিক বলা যায়? এ সম্পর্কে তোমার মত ব্যক্ত কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
গোবিন্দ চন্দ্র দেবের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল জীবনকেন্দ্রিক ও মানবতাবাদী। দর্শনের স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা তা উপমহাদেশীয় চিন্তাধারারই প্রতিফলন এবং সে চিন্তাধারার সূত্র ধরেই তিনি ভাববাদের অনুসারী হয়ে উঠেছিলেন। তবে তিনি তাঁর চিন্তাধারাকে ভাববাদের গতানুগতিক ধারায় ঠেলে দেননি। ভাববাদের সাথে বস্তুবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে জীবনের উপযোগী ও প্রগতির নির্দেশনারূপে তিনি তাঁর নতুন ভাববাদকে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। ড. দেবের দার্শনিক চিন্তার গণ্ডি ছিল বিস্তীর্ণ, যদিও তাঁর চিন্তার ভারকেন্দ্র ছিল মানবজীবন। ড. দেব তাই তত্ত্বজ্ঞানকে জীবনের প্রয়োজন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখেননি। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন সাধারণ মানুষের মঙ্গলময় উন্নত জীবনের, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও আন্ত র্জাতিক মৈত্রীর উপর প্রতিষ্ঠিত এক সুমহান বিশ্বরাষ্ট্রের। তাঁর এ স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়িত করতে চেয়েছেন তাঁর সমন্বয়ী চিন্ত ধারায়। তাই তাঁর সমন্বয়ী দর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ড. দেবের সমন্বয়ী দর্শন : ড. দেব তাঁর Idealism and Progress নামক গ্রন্থে তাঁর সমন্বয়ী দর্শনের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেছেন।
১. প্রচলিত ভাববাদ ও প্রজ্ঞাবাদের সমালোচনা : ‘Idealism and Progress’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়েই দেব তাঁর সমন্বয়ী ভাববাদের প্রতিষ্ঠাকল্পে প্রচলিত ভাববাদের অসাড়তা প্রমাণ করার প্রয়োজন অনুভব করেন। তথাকথিত ভাববাদকে অগ্রাহ্য করার উদ্দেশ্যেই তিনি প্রথমে দর্শনে প্রজ্ঞার ভূমিকা পর্যালোচনা করেন। প্রজ্ঞাবাদীদের প্রজ্ঞার অতি মূল্যায়ন দেব কখনোই সমর্থন করেন না।
২. বাস্তববাদের সমালোচনা : ইন্দ্রিয়ের প্রতি সমসাময়িক দর্শনের আনুগত্যকেও দেব সমর্থন করেননি।অভিজ্ঞতাবাদীরা অপরিবর্তনশীল ঐক্যের ধারণাকে অগ্রাহ্য করে ইন্দ্রিয়কেই সত্তার জ্ঞান লাভের উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ড. দেব তাঁদের মতের বিরুদ্ধে বলতে চান যে, সত্তার যথার্থ জ্ঞান লাভ পরিবর্তনশীল ইন্দ্রিয় দ্বারা সম্ভব নয়। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অভিমত দেন যে, প্রজ্ঞা ও ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা সত্তার জ্ঞানের ক্ষেত্রে সংকটের সৃষ্টি করে।
৩. সমন্বয়ী ভাববাদ : ড. দেব তাঁর ‘Idealism and Progress’ নামক প্রধান গ্রন্থটির ভূমিকায় বলেছেন যে,ভাববাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিরূপতার প্রেক্ষিতেই ভাববাদের সমর্থনে তিনি এ বইটি লিখেছেন। ড. দেব গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করেছেন যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী উগ্র অধ্যাত্মবাদ সাধারণ মানুষের আশা ভরসাকে নস্যাৎ ও নির্মূল করেছে। আজকের দিনের উগ্র জড়বাদও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ড. দেব তাই বলেছেন, “একমাত্র সমন্বয়ী ভাববাদই শুদ্ধ সত্তা। ও বাস্তব জগতের মধ্যে সেতু স্থাপন করে দু’য়ের প্রয়োজনই মিটাতে পারে।” ব্যক্তির প্রয়োজন ও সমষ্টির প্রয়োজন তাঁর নতুন ভাববাদে একই নিক্তিতে ওজন করা যায়। সমন্বয়ী ভাববাদের ধারণার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ন্যায়পর সমাজের প্রাণপ্রবাহ। সমন্বয়ী ভাববাদ এবং একটি আদর্শ অর্থনৈতিক পদ্ধতি পরস্পরবিরোধী তো নয়ই, বরং প্রথমটি দ্বিতীয়টির মৌলিক ভিত্তি রচনা করে।
৪. স্বজ্ঞার অস্তিত্ব স্বীকার : ড. দেব সমন্বয়ী ভাববাদের পক্ষে কেবল ফাঁকা বুলিই আওড়াননি, কোন উপায়ে, কখন, কীভাবে এ ঈপ্সিত ফললাভ সম্ভব তাও তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রজ্ঞা ও ইন্দ্রিয়ের সমন্বয় যদি হয় সমন্বয়ী ভাববাদের প্রথম শর্ত, তাহলে এর দ্বিতীয় শর্ত হবে প্রজ্ঞার বিশুদ্ধ একত্বের ধারণাকে অস্তিত্বশীল করার জন্য বুদ্ধি থেকে স্বজ্ঞায় গমন করা। ড. দেব বিশ্বাস করেন যে, জ্ঞানে পৌছানোর জন্য ইন্দ্রিয়, প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞা নামে যে তিনটি সড়ক রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গমস্থলেই সম্ভবত যুক্তি ঊর্ধ্ব স্বজ্ঞার বিষয়গত দিকটি অবস্থান করছে। খাঁটি একত্বের স্বজ্ঞাই কেবলমাত্র এ দাবি মিটাতে পারে। ড. দেব আমাদের সচেতন জীবনের সংগঠনগত ঐক্যের প্রেক্ষিতে এটা স্বীকার করতে আহ্বান জানান যে, ইন্দ্রিয়, প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞা যেখানে পরস্পরের সাথে মিলে সম্ভবত সেখানে রয়েছে যুক্তি ঊর্ধ্ব স্বজ্ঞার বাস্তবতা ।
৫. সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মীয় অভিজ্ঞতা : ড. দেবের মতে, বিবিধ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা প্রধানত যুক্তি ঊর্ধ্ব স্বজ্ঞা। কেবলমাত্র বুদ্ধির আওতাধীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কেই দর্শন আগ্রহী। ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বুদ্ধির সাথে চলতে চলতে আমাদের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের বিভিন্ন মাত্রার সংঘর্ষকে তাড়িয়ে বুদ্ধিকে অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হয়। ড. দেব বলেছেন, “আত্মসামঞ্জস্যের চেতনা অবশ্যই সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মীয় অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার মধ্যে ইন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞার বৈপরীত্য সমন্বিত হয়।” তাই ড. দেব “যদি শুধুমাত্র অভিন্নতাকে সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বলে বিবেচনা করি, তাহলে আমরা ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও যুক্তিবিদ্যা, যুক্তিবাদ ও যুক্তি ঊর্ধ্ববাদ উভয়ের প্রতি পূর্ণ ন্যায়বিচার করতে পারি।” ধর্মীয় অভিজ্ঞতার চরম অবস্থায় যুক্তিবিদ্যা আত্মসামঞ্জস্যের বিষয়গত সম্ভাবনাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়। তাই যুক্তিবিদ্যার চরম দাবির সাথে সাদৃশ্য আছে বলে অভিজ্ঞতার চেতনা সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. সমন্বয়ী দর্শনের মূলমন্ত্র : যৌক্তিক ধারণা হিসেবে খাঁটি অভিন্নতা যখন যুক্তি ঊর্ধ্ব স্বজ্ঞার সহায়তায় সত্তা বলে পরিগণিত হয়, তখনি ইন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞার আবেদনের ভিত্তিতে একটা সমন্বয়ী তত্ত্ববিদ্যা গঠন করা তেমন কঠিন নয় বলে ড. দেব মত প্রকাশ করেন। ইন্দ্রিয়ের দর্শন হলো নিত্য পরিবর্তনশীল বিশেষসমূহের দর্শন, আর প্রজ্ঞার দর্শন হলো স্থায়ী গুণসম্পন্ন খাঁটি অভিন্নতার দর্শন। স্পষ্টতই সমন্বয়ী দর্শনের মূলমন্ত্র এটি আপাত প্রতীয়মান পরস্পরবিরোধী বিষয়ের নিগূঢ় অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের স্বীকৃতি । ড. দেব তাঁর সমন্বয়ী দর্শনের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার পর তাঁর চিন্তাধারাকে তত্ত্বের গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে মানবজাতির রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে সাধারণের গণ্ডির মধ্যে নিয়ে এসেছেন। তিনি মনে করেন, জ্ঞানের সাপেক্ষে যে জ্ঞান তা যদি বুদ্ধি ও ইচ্ছার সর্বোচ্চ তুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করে, তাহলে ব্যবহারিক কার্যক্ষেত্রের সাথে দর্শনের বহুল সম্পর্ককে কদাচিৎ উপেক্ষা করা যেতে পারে। সত্তার জ্ঞান যদি হয় পূর্ণতার সমানুপাতিক, তাহলে সত্যানুসন্ধানের পিছনে কোনো সচেতন ব্যবহারিক উদ্দেশ্য না থাকলেও তা কোন ক্রমেই কেবলমাত্র তাত্ত্বিক থাকে না, বরং তা অপরিহার্যভাবে ব্যবহারিক হয়ে প্রকাশ
পায়। কাজেই সর্বোচ্চ পূর্ণতা কেবলমাত্র আপেক্ষিকতামুক্ত অভিন্নতার অবগতি নয়, বরং তা হলো সত্তারূপে ভালোবাসা, সৌন্দর্য ও ভালোত্বের সর্বোচ্চ নীতি হিসেবে আপেক্ষিক সমগ্রের অতিরিক্ত সচেতনতা, যা আমাদের সমগ্র তাত্ত্বিক অস্তিত্বকে তৃপ্ত করে।এটা মূর্তের মাঝে বিমূর্তকে, বিমূর্তের মাঝে মূর্তকে দেখে ।
৭. অধ্যাত্মবাদ ও জড়বাদের মিলন : ড. দেব আশা করেন, গতিশীল সত্তার সাথে ব্যক্তির অভিজ্ঞতার সচেতনতা অবশ্যই একদিকে হবে শক্তির ও অন্যদিকে স্থায়ী ভালোবাসা ও প্রগাঢ় সহানুভূতির এক বিরাট উৎস। তখনই সমন্বয় সহজ হবে জীবনের সাথে দর্শনের, বিজ্ঞান ও দর্শনের সাথে ধর্মের, নিরপেক্ষ যুক্তিবাদের সাথে কল্যাণধর্মী প্রয়োজনবাদের, সংশয়ের সাথে বিশ্বাসের, প্রজ্ঞার সাথে স্বজ্ঞার, ধর্ম প্রভাবিত একনিষ্ঠ অধ্যাত্মবাদের সাথে বিজ্ঞানের দেয়া জড়বাদের, বিজ্ঞানের দেয়া শক্তির সাথে দর্শনের দেয়া প্রেমের, ধর্মের সাথে ধর্মের এবং জাতির সাথে জাতির।সর্বোপরি ড. দেব বিশ্বাস করেন যে, সমন্বয়ী ভাববাদ ও একটি আদর্শ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরস্পরবিরোধী তো নয়ই, বরং তা আদর্শ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যৌক্তিক ভিত্তি। ভাববাদের বিরুদ্ধাচরণে নয়, সর্বোন্নত অধ্যাত্মবাদের সাথে সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ জড়বাদের সুস্থ পুনর্মিলন এর দ্বারা অগ্রগতির ধাপ চিহ্নিত হবে। পরস্পরের বিরোধী শুনালেও দেব বলেছেন, “আমি জড়বাদকে, অধ্যাত্মবাদীয়তে ও অধ্যাত্মবাদকে জড়বাদীয়তে পরিণত করেছি।” জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদের মিলনের মধ্য দিয়ে তিনি বড় রকমের বিপর্যয় এড়াতে চান। যদিও ড. দেব মোটামুটিভাবে তাঁর সম্পূর্ণ চিন্তাধারা ‘Idealism and Progress’ গ্রন্থেই লিপিবদ্ধ করেছেন, তবু তাঁর সমন্বয়ী ভাববাদের পূর্ণ তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে মানুষ দেবের জীবনদর্শনের আলোকে তাঁর পরবর্তী গ্রন্থগুলোর কোনো কোনো দিকের প্রতি আলোকপাত করা প্রয়োজন। দেবের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘Idealism: A New Defence and a New Application’ও ভাববাদ সম্পর্কিত। ভূমিকাতে তিনি বলেছেন, পুরনো ভাববাদের সংস্কারের মধ্য দিয়ে তিনি নতুন ভাববাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে যে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব, মানুষের যুক্তি আর বিশ্বাসের মধ্যে যে বৈপরীত্য তা মানবজাতির জন্য অমঙ্গলময় ও দুঃখজনক। শুধু তাই নয়, তা অনিবার্য ধ্বংস ডেকে আনছে। এ বিপর্যয় এড়ানোর জন্য দেব সমন্বয়ের ধারণার সাথে আরো দুটি ধারণা যোগ করে বলেছেন, সমসাময়িক বিশ্বের সমস্যাদির সমাধান নিহিত রয়েছে এক বিশ্ব ও সাধারণ মানুষের ধারণার প্রকৃত অর্থ বাস্তবায়নের মাঝে। তিনি বলেন, মানব কল্যাণের খাতিরেই সমন্বয়ী ভাববাদ বাস্তবায়নের প্রয়োজন এবং তা সকলের বৈপরীত্যের অবসান ঘটিয়ে ঐক্যের ভিত্তিতে ‘এক বিশ্বের’ ধারণা বাস্তবায়িত করবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব একজন সমন্বয়বাদী দার্শনিক। ড. দেব বিশ্বাস করেন যে, সমন্বয়ী ভাববাদ ও একটি আদর্শ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরস্পরবিরোধী তো নয়ই, বরং তা আদর্শ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যৌক্তিক ভিত্তি। ভাববাদের বিরুদ্ধাচরণে নয়, সর্বোন্নত অধ্যাত্মবাদের সাথে সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ জড়বাদের সুস্থ পুনর্মিলন দ্বারা অগ্রগতির ধাপ চিহ্নিত হবে। ড. দেব বলেছেন, “আমি জড়বাদকে অধ্যাত্মবাদীয়তে ও
অধ্যাত্মবাদকে জড়বাদীয়তে পরিণত করেছি।” আর এই জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদের মিলনের মধ্য দিয়েই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*