বাংলার জাগরণে কারা, কী ভূমিকা পালন করেছেন? ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধ’ অবলম্বনে আলোচনা কর।

অথবা, ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধ অবলম্বনে বাঙালিদের জাগরণের ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা মুখ্য, তাদের পরিচয় দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার উপর একটা মধ্যযুগীয় ছাপ যে পড়েছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু নববিকশিত বাংলা সাহিত্যে প্রথম থেকেই সেই ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। বাংলার নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজী, অক্ষয়কুমার দত্ত, কেশবচন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরমহংস, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং।বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায়ের অবদান স্বীকার্য।
বাংলার জাগরণে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হলো :
জাতীয় জাগরণের অগ্রনায়ক : রাজা রামমোহন রায় বাংলার জাগরণের অর্থনায়ক। রামমোহনের নবচিস্তা ও ভাবধারার মধ্য দিয়ে বাঙালির জীবনে পরিবর্তন সূচিত হয়। রামমোহন ছিলেন বহুগুণের অধিকারী। একদিকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, পাশ্চাত্য জীবনাদর্শ অন্যদিকে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ তাঁর সৃষ্টি প্রেরণার অন্যতম উৎস। রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারের মধ্য দিয়ে সনাতন হিন্দু ধর্মে নতুন ভাবধারার সূচনা হয়। রামমোহনকে তাই বাংলার জাগরণের ক্ষেত্রে “প্রভাতসূর্য” বলা হয়। ধর্মচিন্তা, শিক্ষাবিস্তার, সমাজ সংস্কারের মত হিতকরী কাজে রামমোহনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে শত বছরে বাংলায় এমন কোন কর্মীর জন্ম হয়নি। একেবারে আধুনিক কালের সমস্ত মানসিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন রামমোহন রায়।
সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহন : রামমোহন রায় ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একজন সফল সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হন। ‘সতীদাহ প্রথা’ হিন্দুধর্মের একটি ঘৃণিত প্রথা হিসেবে সমাজে চলে আসছিল। রাজা রামমোহন রায় এ ঘৃণিত প্রথার বিলোপ সাধনে আন্তরিকভাবে লড়াই করেছেন। তিনি এ বিষয়ে ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইন প্রণয়ন করিয়েছেন। রামমোহনের কল্যাণেই হিন্দু সমাজ সতীদাহ প্রথার মত একটি জঘন্য ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ করেছে। মুক্তির স্বাদ নিয়েছে অগণিত নিরপরাধ বিধবা নারী।
ডিরোজিওর ভাবনা : সভ্যতার এক সংকটময় মুহূর্তের মধ্য দিয়ে ডিরোজিওর ভাবনা চিন্তা প্রসারিত হয়েছে। গভীর জ্ঞান ও অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার ভালোমন্দ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের চিন্তার স্বাধীনতা বহ্নি তাঁর ভিতরে প্রজ্বলিত ছিল। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র সাম্য ভ্রাতৃত্ব স্বাধীনতা তাঁর ছিল অন্তরের প্রেরণা। ডিরোজিও তাঁর এসব চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে দেন জ্ঞানপিপাসু ছাত্রদের মাঝে।
তৎকালীন সমাজে ডিরোজিওর প্রভাব : তৎকালীন সমাজ এবং রাষ্ট্র ডিরোজিওর চিন্তা-চেতনা মেনে নিতে পারেনি। সংস্কারতীত মানুষগুলো তাই ডিরোজিওকে দেখেছে সন্দেহের চোখে। তাঁর চিন্তা-চেতনা তাঁদের কাছে মনে হয়েছে অসংগত। ফলস্বরূপ তাঁকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। তবে তাঁর চিন্তা-ভাবনা থেমে থাকেনি। প্রাচীনপন্থিরা তাঁকে গ্রহণ না করলেও তরুণ সমাজে তিনি যথেষ্ট সমাদৃত ছিলেন। বাংলার তরুণ সমাজের উপর ডিরোজিওর প্রভাব : হিন্দু কলেজের শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে ডিরোজিও তাঁর বহুমুখী জ্ঞান ও নতুন চিন্তাচেতনার দ্বারা তরুণ ছাত্রসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তিনি তরুণ সমাজের কাছে আদর্শ নেতা হয়ে উঠেন। শ্রেণিকক্ষের বাইরে এবং ভিতরে তিনি তরুণ সমাজের কাছে সমান জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিন বছর শিক্ষকতা করার পর তাঁকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু অল্প সময়ে তাঁর শিষ্যদের চিত্তে যে আগুন তিনি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন কলেজ পরিত্যাগের বহুদিন পরও তার তেজ মন্দীভূত হয়নি। শুধু তাই নয়, ডিরোজিওর এই শিষ্যরাই অনেকে সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। ডিরোজিওর শিষ্যরা অনেকেই চরিত্রবিদ্যা সত্যানুরাগ ইত্যাদির জন্য জাতীয় জীবনের গৌ রবের আসন লাভ করেছিলেন। এরই সাথে হিন্দু সমাজের আচারবিচার বিধি-নিষেধ ইত্যাদির লঙ্ঘনদ্বারা সুনাম বা কুনাম অর্জন করে সমস্ত সমাজের ভিতরে একটা নব মনোভাবের প্রবর্তন করেন। বাংলার নবসাহিত্যের নেতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত ডিরোজিওর চিন্তা-চেতনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এছাড়া ডিরোজিওর মৃত্যুর পরে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে যাঁরা সামাজিক সংস্কারে জ্ঞানবিজ্ঞানে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রামগোপাল ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্যারীচাদ মিত্র প্রমুখ।
অক্ষয়কুমার দত্তের ধর্মচিন্তা : ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার দত্ত অনেকটাই আধুনিক মননের অধিকারী ছিলেন। অক্ষয়কুমার ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। জ্ঞানানুশীলন অক্ষয়কুমারের কাছে এত বড় জিনিস ছিল যে এ ভিন্ন অন্য রকমের প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন না। ব্রাহ্ম ধর্মের ভিত্তি স্বরূপ উপনিষদের যে বাণীটি গ্রহণ করা হয়েছিল তা অক্ষয়কুমারের অন্তরের বাণী ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণের মধ্যযুগীয় মানসিকতার দরুন অক্ষয়কুমারের ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যা জনগণের ভিতরে সাড়া জাগাতে পারেনি।
কেশবচন্দ্রের ধর্মচিন্তা : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রৌঢ় বয়সে কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজের নেতা হন। কেশবচন্দ্র আজন্ম ‘অগ্নিমন্ত্রের’র উপাসক ছিলেন। প্রগলভা ভক্তির জন্য তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বর্জন করতে পারেননি। ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় মানসিকতা থেকে কেশবচন্দ্র বেরিয়ে আসতে পারেননি।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের ধর্মচিন্তা : রামকৃষ্ণের ধর্মচিন্তার প্রভাব হিন্দু চিত্তে যথেষ্ট আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর ধর্মচিন্তার মূল বাণী ‘যত মত তত পথ’ সহজেই মানুষ মেনে নিয়েছিল। এখানে রামমোহনের ধর্মের আধুনিক ব্যাখ্যার চেয়ে জনগণের কাছে রামকৃষ্ণের মতই অধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার উপরে সাহিত্যিকদের প্রভাব : বাংলার নবসাহিত্যের নেতা মধুসূদন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। জাতি-ধর্ম ইত্যাদির সংকীর্ণতা তাঁর সাহিত্যে দেখা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে একজন শিল্পী। শেষ বয়সে তিনি ধর্মের ক্ষেত্রে অতবরণ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মালোচনায় মধ্যযুগীয় মানসিকতা বেশি করে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের দেওয়া জাতীয়তার সঙ্কীর্ণ রূপ ভেঙে বৃহত্তর করতে প্রয়াসী হলেও শেষ পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শই গ্রহণ করেছিলেন।
মধুসূদনের অবদান : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে মধ্যযুগীয় নিগড় থেকে মুক্ত করা মধুসূদনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলেও পশ্চাৎপদ বাঙালি সমাজকে জাগিয়ে তুলতে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা কোন অংশে কম নয়। হিন্দুধর্মের অন্ধত্ব ও গোঁড়ামির জাল ছিন্ন করে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে শিক্ষিত নব্য বাঙালিদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল মুক্তির আন্দোলন। তাঁর বেপরোয়া জীবনাচরণের মধ্যেই ছিল জাগরণের সুপ্ত মন্ত্র। মধুসূদন স্বীয় মেধা ও মননের দ্বারা বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় যে জাগরণের সূচনা করেছিলেন তাকেই ত্বরান্বিত করেছেন মধুসূদন। তিনি ছিলেন বাংলার নন্দিত ও নিন্দিত যুবরাজ। সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে যুগান্তর তিনি সৃষ্টি করে গিয়েছেন তার তুলনা অন্য কারো সাথে চলে না।
বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান : সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে জাগরিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এই অমর কীর্তিতে হয়তো নায়ক নায়িকার গূঢ় আনন্দ বেদনার রেখাপাত তেমন নেই, হয়তো এমন কোন সৌন্দর্য মূর্তি আঁকা হয়নি যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের নয়নে প্রতিভাত হবে, “A thing of beauty is a joy for ever” হিসেবে। কিন্তু তবু এটি অমর এই জন্য যে এতে যেন লেখক কী এক আশ্চর্য ক্ষমতায় পাঠকের সামনে প্রসারিত করে ধরেছেন দেশের দুর্দশামথিত তাঁর রক্তাক্ত হৃদয়- যে হৃদয়ে তার সুগভীর বাস্তবতার জন্যই সৌন্দর্যের এক সমাজকে জাগাতে চেয়েছিলেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজজীবনে জন্মেছিলেন মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্র। রামমোহন প্রদর্শিত পথে তাঁরা না হেঁটেও স্ব-স্ব সৃষ্টপথ তাঁরা বাঙালিকে দেখিয়েছিলেন। তাঁদের উভয়ের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের যে বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত ছিল তা জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তারা অভূতপূর্ব সাফল্য প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছিলেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%b0%e0%a6%a3-%e0%a6%aa%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%80-%e0%a6%86/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*