বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার উপর যে একটা মধ্যযুগীয় ছাপ মারা রয়েছে তা আমরা দেখেছি”- এ উক্তির আলোকে উনিশ শতকের ধর্মচর্চার স্বরূপ নিরূপণ কর।

অথবা, ‘বাংলার জাগরণ” প্রবন্ধ অবলম্বনে উনিশ শতকের ধর্মচর্চার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
রাজা রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারের মধ্য দিয়ে বাংলায় ধর্মের ক্ষেত্রে জাগরণ শুরু হয়। রাজা রামমোহন রায় ধর্মের ক্ষেত্রে যে সংস্কারের সূচনা করেছিলেন তা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষীর ভাবনায় সমৃদ্ধি লাভ করেছে। ধর্মীয় চিন্তাচেতনায় সকল মনীষী একমত হতে না পারলেও তাঁদের ভাবনা সমাজজীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। অসাম্প্রদায়িক গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী সুলেখক কাজী আবদুল ওদুদ ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধে তৎকালীন সমাজের ধর্মচর্চা ও বিভিন্ন মনীষীর ধর্মভাবনা বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চা : ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার মূলে ছিল পৌত্তলিকতা ও অবতারবাদ। বিশ্বাসের থেকে ভক্তির প্রাধান্যই ছিল বেশি। লোকহিতের চেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চা মূলত আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মোটের উপর ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার উপরে সুস্পষ্টভাবে মধ্যযুগীয় প্রভাব বজায় ছিল। প্রাচীন সংস্কার বাঙালির জীবনে এতটাই বদ্ধমূল হয়েছিল যে, নতুন ধ্যানধারণাকে সে সবসময় দূরে সরিয়ে রেখেছিল। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে পরিপুষ্ট রামমোহনের মুক্ত মন হিন্দু ধর্মের এ আচার সর্বস্বনীতি মেনে নিতে পারেনি। পৌত্তলিকতা এবং অবতারবাদের পরিবর্তে তিনি এক পরমব্রহ্মে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য নতুন মত প্রতিষ্ঠা করেন।
রামমোহন রায়ের ধর্মভাবনা : রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারের মধ্য দিয়ে সনাতন হিন্দুধর্মে নতুন ভাবধারার সূচনা হয়। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও জীবনাদর্শে বিশ্বাসী রামমোহন রায়ের উন্মুক্ত মন সনাতন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা অবতারবাদ ইত্যাদি মেনে নিতে পারেনি। এজন্য তিনি পিতা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সাথে বাদানুবাদ করেছেন। গৃহ ত্যাগ করে তিনি তিব্বত ও উত্তর ভারতসহ অনেক স্থান ভ্রমণ করেছেন। আর এ সমস্ত স্থানে ভ্রমণের ফলে নানক, কবীর, দাদু আকবর, আবুল ফজল,।দারাশেকো প্রমুখ ভাবুক ও কর্মীর ভাবধারার সাথে পরিচিত হয়েছেন। এভাবেই ধর্মচিন্তায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ । বাংলা, সংস্কৃত আরবি, ফারসি, ইংরেজি ভাষায় তাঁর অপরিসীম দক্ষতা ছিল। ফলে হিন্দু ধর্মসহ ইসলাম ধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্মের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থে তিনি ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। ইসলামি ও খ্রিস্টীয় শাস্ত্রচর্চার ফলে তাঁর মন একেশ্বরবাদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। পরবর্তীকালে বৈদিকশাস্ত্রে একশ্বরবাদের মহিমা উপলব্ধি করে হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধনে অবতীর্ণ হন। একেশ্বরবাদের উপর ভিত্তি করে তিনি ব্রাহ্ম ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। এক পরম ব্রহ্মে বিশ্বাস স্থাপনই ব্রাহ্ম ধর্মের মূল মন্ত্র। তাই তিনি পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে উঁচু গলায় কথা বলেছিলেন। ধর্মের ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশ এক নিরাকার পরম ব্রহ্মের উপাসনা লোকশ্রেয় ও বিচারবুদ্ধির দ্বারা পরিশোধিত।সেজন্য উপশাস্ত্রসমূহ প্রত্যাখ্যান করে প্রত্যাবর্তন করতে হবে মূল শাস্ত্রসমূহে।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা : দেবেন্দ্রনাথ ঈশ্বরপ্রেমিক পুরুষ ছিলেন। ঈশ্বর প্রেমই ছিল তাঁর অন্তরের অন্তরতম বস্তু। হাফিজের যে সব লাইন তাঁর অতিপ্রিয় ছিল তা’র একটি এই “হর্গিজম্ মোহরে তু আজ্ ওহে দিল ও জান রওদ্।” দেবেন্দ্রনাথ পৌত্তলিকতা ও অবতারবাদে বিশ্বাস না করলেও গভীরভাবে অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাস করতেন। রামমোহনের পরে ব্রাহ্মসমাজ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যানই গ্রহণ করেছিল। ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তিভূমি নির্ণয়ে তিনি যে মনীষার পরিচয় দিয়েছেন তাতে দেশের চিত্তবিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর একটি বড় আসন লাভ হয়েছে। তিনিই জ্ঞানবীর অক্ষয় কুমারের পরামর্শ মত ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি রূপে গ্রহণ করেছিলেন উপনিষদের একটি বাণী। “আত্ম প্রত্যয়সিদ্ধ জ্ঞানোজ্জ্বলিত বিশুদ্ধ হৃদয়।” কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত লক্ষ করি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় মানসিকতা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারেননি। তিনি মানুষের চিত্তকে ব্রহ্ম পাদপীঠ বলে সম্মান দিয়েছেন। শুধু প্রাচীন ঋষিদের যে কেবল সে অধিকার ছিল তা তিনি মানেননি। কিন্তু এ আবিষ্কৃত সত্যের পুরো ব্যবহারে তিনি যেন কেমন সংকোচ বোধ করেছেন।
অক্ষয়কুমার দত্তের ধর্মচিন্তা : ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার দত্ত অনেকটাই আধুনিক মননের অধিকারী ছিলেন।অক্ষয়কুমার ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। জ্ঞানানুশীলন অক্ষয়কুমারের কাছে এত বড় জিনিস ছিল যে এ ভিন্ন অন্য রকমের প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন না। ব্রাহ্ম ধর্মের ভিত্তি স্বরূপ উপনিষদের যে বাণীটি গ্রহণ করা হয়েছিল তা অক্ষয়কুমারের অন্তরের বাণী ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণের মধ্যযুগীয় মানসিকতার দরুন অক্ষয়কুমারের ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যা জনগণের ভিতরে সাড়া জাগাতে পারেনি।
কেশবচন্দ্রের ধর্মচিন্তা : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রৌঢ় বয়সে কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজের নেতা হন। কেশবচন্দ্র আজন্ম ‘অগ্নিমন্ত্রের’র উপাসক ছিলেন। প্রগলভা ভক্তির জন্য তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বর্জন করতে পারেননি। ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় মানসিকতা থেকে কেশবচন্দ্র বেরিয়ে আসতে পারেননি।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের ধর্মচিন্তা : রামকৃষ্ণের ধর্মচিন্তার প্রভাব হিন্দু চিত্তে যথেষ্ট আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর ধর্মচিন্তার মূল বাণী ‘যত মত তত পথ’ সহজেই মানুষ মেনে নিয়েছিল। এখানে রামমোহনের ধর্মের আধুনিক ব্যাখ্যার চেয়ে জনগণের কাছে রামকৃষ্ণের মতই অধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার উপরে সাহিত্যিকদের প্রভাব : বাংলার নবসাহিত্যের নেতা মধুসূদন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। জাতি-ধর্ম ইত্যাদির সংকীর্ণতা তাঁর সাহিত্যে দেখা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে একজন শিল্পী। শেষ বয়সে তিনি ধর্মের ক্ষেত্রে অতবরণ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মালোচনায় মধ্যযুগীয় মানসিকতা বেশি করে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের দেওয়া জাতীয়তার সঙ্কীর্ণ রূপ ভেঙে বৃহত্তর করতে প্রয়াসী হলেও শেষ পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, জাতির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনায় রামমোহন হিন্দু জনসাধারণকে মধ্যযুগীয় ধর্মচর্চা থেকে বের করে এনে আধুনিক জীবনধারার সাথে মেলাতে চেষ্টা করলেও বাঙালির ধর্মচিন্তা মধ্যযুগীয় আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে। শেষ পর্যন্ত হিন্দু জনসাধারণের কাছে প্রতিপন্ন হয়েছে পৌরাণিক ধর্মের কিছুই বাজে নয়। তারই পরতে পরতে রয়েছে উপনিষদের ব্রাহ্মবাদ, হয়তো বা তা’র চাইতেও ভালো কিছু।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%b0%e0%a6%a3-%e0%a6%aa%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%80-%e0%a6%86/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*