প্রজনন স্বাস্থ্য কী? বাংলাদেশের নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য না থাকার কারণ বর্ণনা কর।

অথবা, প্রজনন স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষা না হওয়ার কারণ কী?
অথবা, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা বলতে কী বোঝ? বাংলাদেশের নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য না থাকার কারণসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা কী? বাংলাদেশের নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষা না হওয়ার কারণসমূহ বিস্তারিত উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত নারীদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডওর ১৬ (১) ধারায় নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার সম্বন্ধে বলা হয়েছে শরীক রাষ্ট্রসমূহ বিবাহ ও পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ক সকল ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে সকল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বেইজিং প্ল্যান অব অ্যাকশনে বলা হয়েছে, যৌনতা ও প্রজনন এর সাথে জড়িত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবার অভাবে নারীরা কতকগুলো স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা : জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (ICPD) প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন দলিল অনুযায়ী প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা বলতে বুঝায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য যত্নের মাধ্যমে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক পরামর্শ দান, তথ্যশিক্ষা ও যোগাযোগ সেবা প্রদান এবং সেবার জন্য রেফারাল পদ্ধতি প্রবর্তন ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার চিকিৎসা দান ইত্যাদি। বস্তুত প্রজনন অধিকারের মূল দিক হলো সন্তান ধারণের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নিরাপদ ও কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অধিকার। ১৯৬৮-তে জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণায় এবং পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে বুখারেস্টের জাতিসংঘ জনসংখ্যা
সম্মেলনেও এ অধিকারের কথা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও মানবাধিকার দলিলপত্রে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার ভোগের কথা বলা হয়েছে। অথচ বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটছে। নারীর শরীর ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত নেয় তার স্বামী কিংবা শশুরবাড়ির লোক। এমনকি রাষ্ট্র কিংবা উন্নত বিশ্বের রথী মহারথীরাও তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় নারীর উপর। উন্নত বিশ্বের দেশ ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থাগুলো নির্ধারণ করে আমাদের জনসংখ্যা কেমন হবে, অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য কি কি ব্যবস্থা নিতে হবে, আর সে জন্য নারীর কি কি করণীয়। এক্ষেত্রে নারী কি চায়, তার সমস্যা বা সুবিধা অসুবিধা কি কি? তার শরীর এই ভার বহন করতে পারবে কিনা এসব বিবেচনা না করেই সবকিছু তার উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য না থাকার কারণ : বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল ও দরিদ্র একটি দেশ। নিম্নে বাংলাদেশের নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য না থাকার কারণসমূহ দেয়া হলো :
১. বাল্যবিবাহ : প্রজনন স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিবাহের জন্য একজন নারীর সঠিক বয়স ১৮ এবং একজন পুরুষের ক্ষেত্রে ২১ বছর। কিন্তু ১৮ বছরের নিচে ৭৫ শতাংশ মেয়ে অভিভাবকের ইচ্ছায় বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে প্রজননতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ লাভের পূর্বেই কিশোরী মেয়েরা মাতৃত্ব লাভ করছে। যে মাতৃত্ব নারীকে পূর্ণতা দেয় এক্ষেত্রে সেই মাতৃত্বই কেড়ে নিচ্ছে মা ও শিশুর জীবন।
২. স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব : স্বাস্থ্য সচেতনতা বলতে শুধু দৈহিক স্বাস্থ্য নয়, মানসিক স্বাস্থ্যকেও বুঝায়। প্রজনন স্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষে একজন নারীর সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র এই যে, স্বাস্থ্য সচেতনাতার বিষয়টি আমাদের দেশে নারীদের ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। বিশেষ করে প্রজনন স্বাস্থ্য
সুনিশ্চিতকরণের জন্য যে সকল পন্থা যেমন: পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ, সঠিক ওষুধ সেবন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সুষম খাদ্য গ্রহণ, গর্ভবতী মায়ের টিকা গ্রহণ, সুষ্ঠুভাবে সন্তান জন্মদান প্রভৃতি বিষয়সমূহ সম্পর্কে অনেক সময় নারী নিজে এবং তার পরিবার সচেতন হয় না।
৩. কুসংস্কার : আমাদের দেশের কুসংস্কারগুলোর বেশির ভাগই নারীকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে একজন মেয়ের বয়োসন্ধিকাল থেকে শুরু করে সন্তান জন্মদান এমনকি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মুখোমুখি হতে হয় কুসংস্কারের। এই কুসংস্কারের উৎপত্তি সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি হতে। আর এতে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবে পড়ে প্রজনন স্বাস্থ্য এবং মাতৃত্বের উপর । এই কুসংস্কারগুলো প্রথমত নারীকে গর্ভবতী অবস্থায় সুষম খাদ্য গ্রহণ ও ওষুধ সেবনে বাধা প্রদান করে এবং দ্বিতীয়ত সঠিক সেবা গ্রহণে অনাগ্রহী করে তোলে। কুসংস্কারের ফলে মাতৃত্ব জনিত মৃত্যু ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে নারী প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত স্থায়ী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
৪. নারীর মতামত উপেক্ষা করা : বিয়ের পর নারীর মতামত উপেক্ষিত হয় স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের দ্বারা। বিয়ের পর দেখা যায় যে, সে গর্ভবতী হবে কিনা কিংবা জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করবে অথবা গর্ভপাত করাবে কিনা তা সমস্ত কিছুই নির্ধারিত হয় নারীর পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো উপেক্ষা করে। ইউনিসেফের সহায়তায় নারীবান্ধব হাসপাতালের উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে পাওয়া তথ্যে জানা যায় যে, গ্রামীণ পরিবারের মহিলারা পুরুষ শাসিত সমাজের শোষণ এবং দাবির কাছে অসহায়। এ অবস্থায় নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং মাতৃত্ব নিরাপদ নয়।
৫. সহিংসতা: সহিংসতার কারণে একজন নারীকে সম্মুখীন হতে হয় অবাঞ্ছিত বিপজ্জনক গর্ভধারণ ও গর্ভপাত, অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ এমনকি তাকে হারাতে হয় চিরতরে মাতৃত্ব অর্জনের ক্ষমতা। বিশ্বব্যাংকের মতে কোনো সমাজে নারীর অবস্থান বুঝার ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যুকে একটি আস্থাযোগ্য সামাজিক সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সূচকের নিরিখে বিচার করলে আমাদের দেশে নারীর অবস্থান অনেক নিয়ে। তাই নিরাপদ মাতৃত্ব ও নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন হওয়া আমাদের সফলের কাম্য।
৬. বৈষম্য : ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, অধিক অর্থ উপার্জন, বৃদ্ধ বয়সে আশ্রয় লাভ, বংশধারা অব্যাহত রাখা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পুত্র সন্তান লাভের আশায় অধিক সন্তান গ্রহণ করে থাকে। কারণ আমাদের সমাজে কন্যা সন্তানের চেয়ে পুত্র সন্তান অধিকতর কাম্য। আর পুত্র সন্তান না হলে আমাদের দেশে নারীদের দায়ী করা হয়। ফলে পুত্র ও কন্যা সন্তানের বৈষম্যের কারণে আমাদের দেশের নারীদের মাতৃত্ব ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও তিন এর অধিক সন্তান জন্ম
দেয়ায় বাধ্য করা হয়। শুধু এই ক্ষেত্রেই বৈষম্য নয়, শিক্ষা, খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যও নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য এবং মাতৃত্বের বলয়কে করছে অরক্ষিত।
৭. সেবার ঘাটতি : স্বাধীনতা উত্তরকালে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা দেশের মানুষের জন্য অপ্রতুল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা বসবাস করেন তাদের কাছে স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্বাস্থ্য সেবা, ওষুধ, চিকিৎসা এখনো অনেক দূরের বিষয়। প্রজননের সময় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো তথ্যও তাদের কাছে পায় না।
৮. ডাক্তারের অবহেলা ডাক্তারের অবহেলার কারণে নারীরা প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর প্রচণ্ড ভিড় থাকে। সাধারণত দরিদ্র পরিবারের নারীরা সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে আসে। কিন্তু সেবার পরিবর্তে কখনো কখনো ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীদের হাতে নাজেহাল হতে হয়।
৯. শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর পশ্চাৎপদতা : শিক্ষা দীক্ষায় নারীরা ব্যাপকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী শিক্ষার কিছুটা প্রসার হলেও প্রান্তিক অঞ্চলে নারীরা শিক্ষার সুযোগ পায়নি। তারা শিক্ষার অভাবে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছে না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নারী ও পুরুষের সমতার ভিত্তিতে বিশেষ করে তাদের সন্তান সংখ্যা কত হবে ও সন্তান জন্ম দানে কতটা বিরতি দেয়া হবে সে বিষয়ে স্বাধীনভাবে ও দায়িত্বের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এই অধিকারসমূহ প্রয়োগ সংক্রান্ত সক্ষমতা অর্জনের জন্য তারা যেন যথাযথ তথ্য, শিক্ষা ও ব্যবস্থা পায় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*