পরিসংখ্যান কাকে বলে? পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা কর ।

অথবা, পরিসংখ্যান বলতে কী বুঝ? পরিসংখ্যানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
অথবা, পরিসংখ্যানের সংজ্ঞা দাও। পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সভ্যতা সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে বিভিন্ন গাণিতিক প্রয়োজনে মানুষ পরিসংখ্যান ব্যবহার করেছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় পরিসংখ্যান মানব সভ্যতার প্রাচীন যুগতো বটেই, মধ্যে ও আধুনিক যুগের কর্মকাণ্ডেও ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক যুগে এসে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বহুমুখী ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের ব্যবহার দিন দিন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে।
পরিসংখ্যান : ইংরেজি ‘Statistics’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে পরিসংখ্যান। ‘Statistics’ শব্দটি ইটালীয় শব্দ ‘Statista’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র’। ‘Statistics’ শব্দটি সর্বপ্রথম Gottfried Achen Wall ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যবহার করেন। এ বিষয়কে তিনি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন দেশের সাথে পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে এ বিষয়টি আবিষ্কার করেন ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন পরিসংখ্যানবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিসংখ্যানের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন । নিয়ে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
A. L. Bowley পরিসংখ্যানকে ‘গড়ের বিজ্ঞান’ (Science of average) নামেও অভিহিত করেছেন । যদিও গড় | তথ্যাবলি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল, তথাপি এটি বহুসংখ্যক পরিসংখ্যান প্রণালির মধ্যে একটি প্রণালি মাত্র। কাজেই এটা সমগ্র পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না।
ডব্লিউ. আই. কিং (W.I. King) এর মতে, “Statistics is the science of decision making in the field of uncertainty.” অর্থাৎ, অনিশ্চিত বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিজ্ঞানই হলো পরিসংখ্যান। এ সংজ্ঞাতে কোন বিষয় | সম্পর্কে ব্যাখ্যামূলক সিদ্ধান্ত নেয়ার উপর জোর দেয়া হয়েছে । Selingman এর পরিসংখ্যানের সংজ্ঞানুসারে, “কোন অনুসন্ধানে তথ্য সংগ্রহ, শ্রেণিবদ্ধকরণ, উপস্থাপন, তুলনাকরণ এবং ব্যাখ্যাকরণই হলো পরিসংখ্যান।”
ওয়েবস্টার (Webstar) এর মতে, “পরিসংখ্যান হলো কোন রাষ্ট্রে জনসাধারণের অবস্থা সম্পর্কিত শ্রেণিবদ্ধ তথ্যাবলি বিশেষভাবে সেসব তথ্যগুলো সংখ্যা বা সংখ্যার সারণি অথবা যে কোন রূপ সারণি আকারে বা শ্রেণি বিন্যাসের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়।” পরিশেষে আমরা বলতে পারি, পরিসংখ্যানের উপর্যুক্ত সংজ্ঞাসমূহ কোনভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। পরিসংখ্যানের সবচেয়ে সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন অধ্যাপক এইচ. সেক্রিস্ট। তাঁর মতে, পরিসংখ্যান দ্বারা আমরা কোন পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্যে শ্রেণিবদ্ধভাবে প্রভাবিত তথ্যাবলির সমষ্টিকে বুঝে থাকি। অধ্যাপক সেক্রিস্ট প্রদত্ত এ সংজ্ঞাকে পরিসংখ্যানের আদর্শ সংজ্ঞা বলা হয়ে থাকে ।
পরিসংখ্যানের ক্রমবিকাশ : আধুনিক অর্থে পরিসংখ্যান বিজ্ঞান ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের বুদ্ধিবাদী প্রয়াসের ফলশ্রুতি। অবশ্য বিষয় হিসেবে এ বিজ্ঞানের উদ্ভব প্রাচীন কালে। যাযাবর জীবন পদ্ধতি পরিত্যাগ পূর্বক মানবজাতি যখনই সমষ্টিগত জীবন যাপনের পথে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তখন হতেই ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পর্যায়ে মানুষ একে অপরের শক্তি, সম্পদ এবং অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার প্রবণতা দেখায় । মধ্যযুগের ঐতিহাসিক বিবরণাদি বিশ্লেষণ করলেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ঐ সময়ে সরকারি পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। অবশ্য এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণে ব্যবহার করা। ঐ সময়ের ইতিহাসে এরূপ তথ্য সংগ্রহের নজির পাওয়া যায় । কালজয়ী উইলিয়াম (William) ১০৮৫ সালে তাঁর ডুমস্‌ডে (Doomsday) গ্রন্থে ইংল্যাণ্ডের অর্থনৈতিক সফলতার অগ্রগতির অফিস পরিসংখ্যান তৈরি করেন। লিপিবদ্ধ আকারে এটাই ছিল সর্বপ্রথম অফিস রেকর্ড । সপ্তদশ শতাব্দীতে জৈব ও সাম..এক পরিসংখ্যানের বিকাশের পাশাপাশি গাণিতিক সম্ভাবনাতত্ত্বের (Probability theory) গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত্ব হয় । প্যাসক্যাল, ফারমেট, দ্য মেয়ার, জে. বার্নৌলি এবং এস. পৈঁসু (S. Poisson) সম্ভাবনাতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন । জুয়া খেলায় জেতার সুযোগ নিরূপণের সাথে জড়িত এ তত্ত্বটি ধীরে ধীরে বিকাশলাভ করে ।
অধ্যাপক জে. বার্নৌলি (J. Bernoulli 1654-1705) তাঁর বিখ্যাত ‘Ars Conjectandi’ নামক গ্রন্থে সম্ভাবনা তত্ত্বের প্রণালিবদ্ধ আলোচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর নিকোলাস বার্নৌলি তাঁর গ্রন্থ প্রকাশ করেন । এর মাধ্যমে ‘Law of Large Number’ তত্ত্বের ধারণা পাওয়া যায়। নিকোলাস বানৌলি (1749–1827) নিজেও সম্ভাবনাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন এবং ‘নৈতিক প্রত্যাশাতত্ত্ব’ (Theory of Moral Expectation) উদ্ভাবন করেন। পরবর্তী কালে এ সম্ভাবনা তত্ত্বই আধুনিক পরিসংখ্যানের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পরিসংখ্যান তত্ত্বের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা পদ্ধতির উন্নতি বিধানের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হয় । পরিসংখ্যান তথ্যের পরিধি বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেগুলো প্রয়োগের ফলে এই উন্নতি বিধানের প্রয়োজন আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। জে. বি. ছামিলচ্ (১৭০৭-১৭৬৭) ব্যবহারিক তথ্যের সাহায্যে স্বাভাবিক বিন্যাস মতবাদ ‘Doctrine of natural order’ প্রমাণের প্রয়াস পান এবং ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ।
স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটন (Galton 1822-1911) মানুষের বংশগত বিবর্তন ও এক পুরুষ হতে পুরুষে দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যসমূহের সঞ্চারিত হওয়ার বিধিসমূহ নির্ধারণ করার জন্য পরিসংখ্যান তথ্যাবলি ব্যবহার করেন। এভাবে তিনি নির্ভরণ রেখার (Regression line) ধারণা প্রবর্তন করেন। গ্যালটনের পরে কার্ল পিয়ারসন (Karl Pearson, 1857–1936) এবং স্যার আর. এ. ফিশার (Sir R. A. Fisher) জীববিদ্যা বিষয়ক তথ্যাবলি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। উভয়েই বহু সংখ্যক মৌলিক তত্ত্ব উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করেন। কার্ল পিয়ারসনের উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব হলো
সংশ্লেষাংক (Correlation), কাই-বৰ্গ (Chi-square), স্টোকাটিক প্রসেস (Stochastic process) এবং ফিশারের
তত্ত্বগুলোর মধ্যে : যাচাই (t-test) ও ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণ (Analysis of Varience) উল্লেখযোগ্য যা জেনেটিক, বায়োস্টেটিকস্ এবং কৃষিবিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেন। এ কারণে Sir R. A. Fisher কে পরিসংখ্যানের জনক বলা হয়। পরবর্তীতে ইয়েটস্ (১৮৮৩) কাইবর্গের সংশোধনীসহ ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণ ও পরীক্ষণের ডিজাইনের বিন্দু তত্ত্ব (Theory of point) প্রবর্তন করেন । O. H. Hartly এবং P.C. Mohanobilish নমুনায়ন এবং নমুনা তথ্য বিশ্লেষণে মৌলিক বিন্দু তত্ত্ব এবং ধারণা প্রবর্তন করেন । অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বার্নৌলি, ল্যাপলাস এবং অন্যান্য বিখ্যাত গণিতবিদদের প্রচেষ্টায় সম্ভাবনা তত্ত্বের বিকাশ, এল.এ. জে. কুইলেট (L. A. J. Quetlet 1796–1874) প্রণীত ভেদ বিধি (Law of Variability) এবং ‘Law of Constancey of Great Numbers’ এবং গস্ (Gauss) কর্তৃক প্রণীত ‘স্বাভাবিক রেখা’ (Normal curve) ও ন্যূনতম বর্গ পদ্ধতি (Least Square Method) ইত্যাদি আধুনিক পরিসংখ্যানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে দেয়। এছাড়াও আগস্ট মিটজেন, প্যারেটো, এডাম, এজওয়ায, এ. এল. বাউলি, জি-উড্‌নি ইউল, এন.জি. কেন্ডাল, সি. আর. রাও প্রমুখ আরো বহু বিশেষজ্ঞের অবদানে সমৃদ্ধ হয়ে পরিসংখ্যান একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অর্থনীতিতে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ অনেকাংশে পরিমিত ছিল, যদিও সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ডব্লিউ. পেটি এবং জি. কিং প্রমুখ ব্যক্তি অর্থনীতিতে পরিসংখ্যানের সূত্র প্রয়োগের সূচনা করেন । অষ্টাদশ শতাব্দীতে পরিসংখ্যান তথ্যের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য বাড়লেও এর প্রভাব অর্থনীতিতে তেমন পড়েনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ হতে. পরিসংখ্যান তথ্যের ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় । ডব্লিউ. এস. জেবনস্ ১৮৭১ সালে প্রকাশিত তাঁর অর্থনীতির ক্ষেত্রে Theory of Political Economy’ গ্রন্থে পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের বিধিসমূহের সাহায্যে অর্থনৈতিক বিধিগুলোর কার্যকারিতা যাচাই করার প্রয়োজনীয়তার উপর বিশেষ জোর দেন। এতদসূত্রে তিনি আরো পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থ পরিসংখ্যান তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দেন। তিনি ঋতুগত ভেদ, যুগব্যাপী সাধারণ ধারা ও চক্রের ক্রমিক উঠানামা এবং সূচক সংখ্যার ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে জেবনকে সূচক সংখ্যার জনক বলা হয়। তিনি অর্থনৈতিক চলকগুলো বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান নিয়মসমূহ প্রয়োগ করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বহুসংখ্যক অর্থনীতিবিদের প্রচেষ্টার ফলে পরিসংখ্যান এবং অর্থনীতির মধ্যে একটি সমঝোতাশীল সংযোগ গড়ে উঠে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিশিষ্ট
অর্থনীতিবিদগণ হলেন আলফ্রেড মার্শাল, প্যারেটো এবং এজওয়ার্থ সমধিক খ্যাত। তারা উক্ত সময়ে অর্থনৈতিক তথ্যাবলি কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে কতকগুলো নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। পরিসংখ্যানের তত্ত্বসমূহের উন্নতি এবং সেগুলোর প্রয়োগে অর্থনীতির ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান পদ্ধতির প্রয়োগের পথকে সহজ করে দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান তত্ত্বগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের পণ্ডিতবর্গের উদ্ভাবিত তত্ত্ব ও তত্ত্বসমূহের প্রয়োগের ফলে বর্তমান পরিসংখ্যান একবিংশ শতাব্দীর মানবকল্যাণ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, প্রযুক্তিগত বিদ্যাসহ সকল বিষয়ের উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে প্রায় পরিপূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক একটি আদর্শ বিষয় হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে ।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*