গণমাধ্যম কী? নারী ও গণমাধ্যমের সম্পর্ক কি? এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা কর।

অথবা, গণমাধ্যম বলতে কী বুঝ? নারী ও গণমাধ্যমের সম্পর্ক আলোচনা কর।
অথবা, গণমাধ্যম কী? নারী ও গণমাধ্যমের মধ্যে সম্পর্ক বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
আধুনিক পৃথিবীতে গণমাধ্যম আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতার অংশ। সংবাদপত্র, সাময়িকী, বই, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রেডিও বা ইন্টারনেট যত ধরনের গণমাধ্যম আছে, আমরা কেউ তার আওতার বাইরে নয়। সারাদিনে একবারও গণমাধ্যমের সংস্পর্শে আসে নি, আধুনিক শহুরে মানুষের পক্ষে এ ঘটনাটি ঘটা একেবারেই অসম্ভব। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও গণমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। গণমাধ্যমের সাথে নারীর একটা সম্পর্ক আছে। গণমাধ্যমে আমরা নারীর বিভিন্ন ইমেজ দেখতে পাই। তবে বাস্তবে নারীর যে বহুমাত্রিক অবস্থান, গণমাধ্যমের রক্ষণশীল দৃষ্টিকোণ তার সম্পূর্ণ শনাক্ত করে না। গণমাধ্যম এখনও জোর দেয় নারীর দৈহিক সৌন্দর্যের উপর তার মেধা বা সৃজনশীলতার উপর নয়। নারীর সাথে গণমাধ্যমের সম্পর্ক আলোচনা করাই এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য। নিম্নে গণমাধ্যম কি এবং গণমাধ্যমের সাথে নারীর সম্পর্ক কি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
গণমাধ্যম : ইংরেজি ‘Mass Media’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে গণমাধ্যম। Mass ‘অর্থ’ গণ আর Media অর্থ ‘মাধ্যম’। সুতরাং ‘গণমাধ্যম’ হচ্ছে ‘জনগণের মাধ্যম’। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম আছে। যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সাময়িকী, বই, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট ইত্যাদি। এসব গণমাধ্যম থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য
পেয়ে থাকি।
নারী ও গণমাধ্যমের সম্পর্ক : গণমাধ্যম ও নারীর সম্পর্কটি তিনটি দিকমাত্রা থেকে দেখা যেতে পারে। এ তিনটি দিক হলো :
১.গণমাধ্যমে নারীর রূপায়ণ (Portrayal),
2.গণমাধ্যমের কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা (Participation) এবং

৩.গণমাধ্যমের দর্শক-শ্রোতা-পাঠক (Audience) হিসেবে নারীর প্রয়োজন পূরণের ন্যায্যতা।
এ তিনটি মাত্রা নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো ঃ
. গণমাধ্যমে নারীর বয়স বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারী যেভাবে চিত্রিত হয় তাকে যদি দু’টি শব্দে সংক্ষিপ্ত করতে হয় তবে শব্দ দু’টি হবে : ‘প্রান্তিক’ ও ‘নেতিবাচক’ । গণমাধ্যম সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় নারী উপস্থাপনের যে চিত্র ফুটে উঠে তা হলো :
১.সংবাদ মাধ্যমে নারীকে স্থান দেওয়া হয় অত্যন্ত কম। মনে করা হয়, পুরুষই ঘটনার সংঘটক, নারী ঘটনার অক্রিয় অংশ।
২.সংবাদ মাধ্যমে নারী যখন উপস্থিত হয়, তখন তাকে বেশি পাওয়া যায় দু’টি ক্ষেত্রে, অপরাধ ও বিনোদন অপরাধের ক্ষেত্রে নারী এর শিকার এবং বিনোদনের ক্ষেত্রে সামগ্রী।

৩. সংবাদ মাধ্যমে নারী বিষয়ক সংবাদের সংখ্যা পরিমাণগত দিক থেকে বৃদ্ধি পেলেও গুণগত দিক থেকে সংবাদে নারীর যথাযথ মর্যাদা প্রদানের বিষয়টি এখনও প্রশ্নসাপেক্ষ রয়ে গেছে। অপরাধ বিষয়ক সংবাদে এখনও অপরাধীর চেয়ে সংশ্লিষ্ট নারীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অধিকতর তথ্য প্রকাশ, কিংবা ধর্ষণের মত অনুবাদের কত্রেও উত্তেজক বর্ণনা দেওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
৪. বিনোদন মাধ্যমে নারীকে কিছু সীমিত, গত্বাঁধা ভূমিকায় দেখা যায় : যেমন- কন্যা, প্রেয়সী, জায়া ও জননী। নারীর প্রকৃতিকে দেখানো হয় গৃহমুখী, দুর্বল ও পরনির্ভর।

৫. চলচ্চিত্রে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মত গুরুতর অপরাধকে বিনোদনের উপজীব্য করে তোলা হয়।

৬. বিজ্ঞাপনে নারী সরাসরিভাবে পণ্য।গণমাধ্যমে নারীর এভাবে উপস্থাপনের সমস্যা হল এই যে, নারীর অধস্তন অবস্থানের যারা পরিবর্তন চায়, তারা সবাই উপলব্ধি করে যে, সমাজে জেন্ডার যেভাবে নির্মিত হয়, সে নির্মাণের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা দরকার। বার বার আমরা প্রমাণ পাই, নারীর নির্যাতনের শিকার হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে নারী সম্বন্ধে সমাজের মূল্যবোধ। যদি কোন সমাজের মূল্যবোধ এই হয় যে, নারী তুচ্ছ, তাকে অপমান বা নির্যাতন করা যায়, তবে নানাধরনের সামাজিক সংগঠনের সামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি গণমাধ্যমও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধ্য দিয়ে সে সমাজের সকলে এই মতাদর্শে দীক্ষিত হন। আমাদের সামাজিকীকরণে পরিবার, শিক্ষায়তন ও অন্যান্য
২. পেশাজীবী হিসেবে গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা : প্রচারমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি দু’টি দিক থেকে চিন্তা করা হয় :
ক. গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক ও প্রান্তিক ভাবমূর্তি গঠনের সঙ্গে গণমাধ্যম পেশায় নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত বলেও অনেকে মনে করেন। দেখা যায়, বিভিন্ন গণমাধ্যমের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী পর্যায়ে এবং গণমাধ্যমের আধেয় তৈরিতে নারীর উপস্থিতি নগণ্য কিংবা নেই বললেই চলে। এর ফলে পুরুষ প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং পুরুষ শ্রোতা-দর্শক-পাঠকের কথাই প্রধানত মনে রেখে গণমাধ্যম আধেয় তৈরি করা হয়।
খ. গণমাধ্যমের কর্মক্ষেত্রে যদি নারীর উপস্থিতি যথেষ্ট না হয়, তবে কর্মজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীকে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে একথা বলা যায় না।

যদিও মুদ্রণ মাধ্যমে নারীরা কাজ করছেন বহু বছর ধরে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলোতে জন্মলগ্ন থেকে; তার পরেও কোন জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক পদে, কিংবা রেডিও টেলিভিশনের মহাপরিচালক পদে কোন নারী আমরা দেখি ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বাদ দিলাম, এমনকি আধেয় নির্মাণে যেমন- রিপোর্টিং -এ, স্ক্রিপ্ট লেখায়, ক্যামেরায়, পরিচালনায়
নারী অদৃশ্য ।
৩. অডিয়েন্স নারী : গণমাধ্যমে যা দেখানো হয়, যেভাবে পৃথিবীর বা দেশের সমস্যার ব্যাখ্যা করা হয়, তা তৈরি হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, আইন সমস্ত কিছুর মধ্যে রয়েছে পুরুষে চোখে দেখে বিশ্লেষণ । নারীর বক্তব্য, তার সমস্যা যদি অনুপস্থিত থাকে সবসময়, তবে বলা যায় নারীর সমান অধিকার
প্রতিষ্ঠা, তার ন্যায্যতা অর্জন একটি আকাশকুসুম কল্পনামাত্র হয়ে থাকবে। আমাদের সংস্কৃতি থাকবে পুরুষতান্ত্রিক। আর সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা প্রতিটি নারী-পুরুষ এ ধারণাতেই দীক্ষিত হতে থাকবে। কেননা গণমাধ্যম অনেকাংশে আমাদের দেখার চোখটা তৈরি করে। যখন চারদিক থেকে গণমাধ্যম নারীর খণ্ডিত এবং গত্বাঁধা ইমেজ ধর্ষণ করে জানাচ্ছে যে,
গণমাধ্যমের নারীই প্রকৃত নারী, নারীর এ রকমই হওয়ার কথা, তখন নারীর অন্যকিছু হওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে গণমাধ্যমের সাথে নারীর ইতিবাচক সম্পর্কই ইতিবাচক ইমেজে গড়ে তোলার জন্য করণীয় : সমাজে ও উন্নয়ন নারীর সম্পৃক্তকরণের জন্য গণমাধ্যম একটি প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যম কিভাবে নারীর ভামূর্তিকে তুলে
ধরছে, কিভাবেই বা গণমাধ্যম আরও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে, এ বিষয়ে ১৯৭৫ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে আলোচনা, গবেষণা পরিচালিত হতে থাকে। এরও দু’দশক পরে ১৯৯৫ সালের চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে নারী উন্নয়নের পথে যে ১২টি বাধা শনাক্ত করা হয়, গণমাধ্যম তার মধ্যে একটি।বেইজিং প্লাটফরম ফর অ্যাকশন এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে যে নারী উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ করেছে ‘গণমাধ্যম ও নারী’ বিষয়ক অংশে নিম্নলিখিত বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে :
১.গণমাধ্যমে নারীর সঠিক ভূমিকা প্রচার, প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং অংশগ্রহণ বৈষম্য দূর করা; গণমাধ্যমে নারী ও মেয়ে শিশুর অংশগ্রহণ, মতামত প্রকাশ, সিদ্ধান্তগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং নারী ও মেয়ে শিশুর
ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটানো;
২.নারীর প্রতি অবমাননাকর, নেতিবাচক, সনাতনী প্রতিফলন এবং নারীর
ব্যবস্থা করা;
৩. বিভিন্ন গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপনা ও আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণে নারীর জন্য সমান সুযোগ রাখা;

  1. প্রচারমাধ্যমের নীতিমালায় জেণ্ডার প্রেক্ষিত যুক্ত করা;
    উপরিউক্ত বিষয়সমূহের আলোকে আইন, প্রচারনীতি, নিয়ন্ত্রণবিধি এবং আচরণবিধি প্রণয়ন করা।
    উপরিউক্ত সুপারিশগুলো যদি পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে গণমাধ্যমের সাথে নারীর একটি ইতিবাচক
    সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং সমাজে নারীদের সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে তা দূর হবে।
    উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সমাজে নারীর যে বৈষম্যমূলক অবস্থান, তার জন্য
    গণমাধ্যম একা দায়ী নয় এবং গণমাধ্যমই শুধু নারীর নেতিবাচক ইমেজ প্রতিষ্ঠা করে না। গণমাধ্যম ও নারীর মধ্যকার
    নেতিবাচক সম্পর্কের জন্য দায়ী আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক মতাদর্শ, যা আমাদের শৈশব থেকে শেখানো হয়
    পরিবারে, প্রথা সংস্কৃতি ধর্ম আইন দিয়ে যাকে জোরদার করা হয়। গণমাধ্যম এ জেন্ডার বৈষম্যকে যেমন জোরদার করবার
    জন্য ভূমিকা রাখতে পারে বা রাখছে, তেমনি জেন্ডার সমতার মূলবোধও শেখাতে পারে। গণমাধ্যম তো জনগণেরই
    মাধ্যম। অর্থাৎ আমাদের সকলের মাধ্যম। তাই গণমাধ্যমের সাথে নারীর ইতিবাচক সম্পর্কে গড়ে তোলার জন্য আমাদেরই
    এগিয়ে আসতে হবে।
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*