ঐকতান’ কবিতায় কবি সাধারণ মানুষের যে জয়গান গেয়েছেন তার পরিচয় দাও।

উত্তর : ‘ঐকতান’ শীর্ষক কবিতায় রবীন্দ্রমানসের বহু বিচিত্র ও অত্যাশ্চর্য বিষয় ধরা দিয়েছে। কবি সমগ্র জনগোষ্ঠীকে কাব্যে স্থান দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। অপরদিকে কবি তাঁর জীবনদৃষ্টি অধ্যয়নের মাধ্যমে পূর্ণ করেছেন। তাই ‘ঐকতান’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) অন্তরের পরিচয়সমৃদ্ধ অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। ‘ঐকতান’ কবিতাটি কবির মৃত্যুর বছরই ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবি যখন তাঁর
কাব্যকীর্তির মূল্যায়নে ব্রতী হলেন তখনই তাঁর দুর্বল দিকগুলো ধরা পড়ল। তাঁর কাব্যে সমগ্র জনগোষ্ঠী অনুপস্থিত। তিনি ‘ঐকতান’ কবিতায় সাধারণ মানুষের চিত্র এবং তাদের বিভিন্ন বিষয় সহজ-সরল ফুটিয়ে তুলেছেন এবং তাদের কথা এতদিন না বলতে পারার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও কবি এ-কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বের সর্বত্র মানুষ বিরাজমান। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বলোকে মানুষ একাকার হয়ে আছে। কবি সমগ্র বিশ্বকে জয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতার কারণে তাঁর পক্ষে জয় করা সম্ভব হয়নি। এমনকি বিশ্বসাহিত্যের দরবারে আত্মসংযোগ করাও সম্ভব হয়নি। এ অতৃপ্তিই জীবনের শেষ বেলায় কবিকে দগ্ধ করেছে। তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে স্বীকার করেছেন :


“সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।
মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে;
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।”


কবি সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করার জন্যই সর্বসাধারণের সাথে তাঁর সংযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কারণ সমাজে শ্রেণিগত বৈষম্য ছিল প্রবলভাবে। ফলে তিনি তাদের সাথে মিশতে পারেননি। সাহিত্যের এ সংযোগহীনতার কারণে তাঁর সাহিত্য সর্বজনীনতার ক্ষেত্রে দুর্বল। কবি বলেছেন-


‘পাইনে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার
বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার’-


কবি উচ্চবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। উচ্চবিত্ত থাকার কারণে নিচু শ্রেণি নিয়ে সাহিত্যসাধনা করা সম্ভব হয়নি। বিশ শতকের সাহিত্যে যান্ত্রিকতার হাওয়া লাগার কারণে আর্টনির্ভর সাহিত্য রচিত হলো। ফলে এ সাহিত্য নিচু শ্রেণির মানুষের উপভোগ্য হলো না। আর্টনির্ভর সাহিত্যের ধারা থেকে নিচু শ্রেণির কাতারে কবি শামিল হতে পারলেন না। জীবনের প্রান্ত বেলায় এসে নিচু শ্রেণির প্রতি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন কবি। যাদের শ্রমে ঘামে সভ্যতার সৃষ্টি তাদের বাদ দিয়ে নন্দিত কাব্য হতে পারে, তবে তা কখনো জীবন ঘনিষ্ঠ নয়। কিন্তু এ পর্বে এসে কবি এসব সাধারণ মানুষের অবদান তিনি বিনয়ের সাথে তুলে এনেছেন তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতায়। যেমন-


“চাষি ক্ষেত্রে চালাইতেছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-
বহুদূরপ্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তার’পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।”


কবি সম্ভ্রান্তবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আভিজাত্যের বলয়ে থাকার কারণে নিম্ন শ্রেণির মানুষের সাথে তাঁর মেশা সম্ভব হয়নি। ফলে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তাঁর সাহিত্যে মধ্যবিত্ত সমাজ বাস্তবতা প্রাধান্য লাভ করেছে। অপরদিকে, এ সাহিত্য সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য উপভোগ্য হলো না। কবি মধ্যবিত্ত সাহিত্যধারা থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির সাহিত্য ধারায় অবগাহন করতে পারলেন না। ফলে কবি নিজেই তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন:


“জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে, কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।


কবি নিজ সাহিত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। বিশ্বকবির দরবারে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও কবি বিশ্বাস করতেন তাঁর সাহিত্যে সমগ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। এ কারণে কবি জীবনে যা করতে পারেননি- নবীন কবিদের প্রতি তা করার আহ্বান জানিয়েছেন। মাঝি তাঁতী, কৃষক, কামার যেন তাদের সাহিত্যে উঠে আসে। তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না যেন সাহিত্যে রূপায়ণ হয়ে উঠে। এ কামনায় বিভোর হয়ে তিনি উচ্চারণ করেছেন-


(i) এসো কবি অখ্যাতজনের নির্বাক মনের;
মর্মের বেদনা যত করিয়ো উদ্ধার।
(ii) যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।


সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, ‘ঐকতান’ কবিতায় কবি কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, কামারসহ সাধারণ মানুষের জয়গান গেয়েছেন। কবি মনে করেন এদের উপরই ভর দিয়ে জগৎ-সংসার চলছে। কবি এতদিন যা তাঁর কবিতায় তুলে ধরতে পারেননি; শেষ বেলায় এসে কবি অন্তত কিছুটা হলেও তাঁর মনের কথা এ কবিতায় তুলে আনতে সচেষ্ট ছিলেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%90%e0%a6%95%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a5-2/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*