ইয়ং বেঙ্গল কারা? ইয়ং বেঙ্গল প্রতিষ্ঠায় হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’র ভূমিকা বর্ণনা কর।

অথবা, বাংলায় ইয়ং বেঙ্গল বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে? ইয়ং বেঙ্গলের সাথে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও কতটুকু সম্পৃক্ত ছিলেন? আলোচনা কর।
অথবা, ইয়ং বেঙ্গল কারা? ইয়ং বেঙ্গল প্রতিষ্ঠায় হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’র অবদান আলোচনা কর ।
অথবা, ইয়ং বেঙ্গল কারা? ইয়ং বেঙ্গল প্রতিষ্ঠায় হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’র কী কী ভূমিকা ছিল? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
উনিশ শতকের প্রথমে বাংলায় যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তারই একটি সাংগঠনিক ও সামগ্রিক প্রয়াস হচ্ছে ইয়ং বেঙ্গল। কলকাতা হিন্দু কলেজের তৎকালীন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ছিলেন এর অগ্রপথিক। ডিরোজিও ছাড়াও এ সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন হিন্দু কলেজেরই প্রথিতযশা কিছু শিক্ষক এবং প্রগতিশীল ছাত্ররা এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের প্রচলিত ভাবাদর্শের যুক্তিবাদী সংস্কার, সমাজকে অন্ধকার, কুসংস্কার ও সামাজিক অন্যায় অবিচার হতে মুক্ত করা।
ইয়ং বেঙ্গলদের পরিচয় : রাজা রামমোহন রায়ের পরে উদারপন্থি ভাবধারার বিকাশে ধাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তারা সাধারণত ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত। এ গোষ্ঠীর দীক্ষাতক ছিলেন কলকাতা হিন্দু কলেজের অ্যাংলে ইন্ডিয়ান শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১)। ডিরোজিও পরিসের মতে, রামমোহনের সংখ্য আন্দোলন আধুনিক সফল হলেও তা দলিত পরিণতি লাভ করতে পারেনি। তারা বিশেষত সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন আধ্যাত্মিকতা ও মরমীবাসের প্রতি এবং অনুরাগী হলেন বস্তুবাদী ভাবধারা প্রগতিশীল জীবনদর্শনের।ডিরোজিওড়াও
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের অন্যতম চিন্তানায়ক ছিলেন ডেভিড হেয়ার। খ্রিস্টান মিশনারীরা সেকালে ছাত্র সমাজকে প্রভাবিত করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল তার করাল গ্রাস থেকে হিন্দু কলেজের ছাত্রদেরকে রক্ষা করার, সে সঙ্গে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস, অনাচার ও অবক্ষয় থেকে ছাত্রদের রক্ষা করার এবং সখি মন চিন্তা গড়ে তোলার কাজে নি জীবনপাত করেছিলেন। উপর্যুক্ত মহান চিন্তানায়কদের অনুসারী হয়ে ধারা এ আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন তাঁরা
হচ্ছেন কলকাতা হিন্দু কলেজের প্রগতিশীল কিছু শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মাধবচন্দ্র মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, মহেশচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, রচন্দ্র ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, গোবিন্দ চন্দ্র বসাক ও অমৃতলাল মিত্রের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।সুতরাং বলা যায়, হিন্দু কলেজের প্রগতিশীল কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলায় যে সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড পরচাপিত হয় তাই ইতিহাসের পাতায় ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত।
ইয়ং বেঙ্গল প্রতিষ্ঠায় হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’র ভূমিকা : কলকাতা হিন্দু কলেজের শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’র জীবনকাল অত্যন্ত সীমিত। তিনি ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৩) সালে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন পর্তুগিজ এবং মা ইংরেজ তনয়া। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে ইংরেজদের ছাড়া অন্য ইউরোপীয়রা রাষ্ট্রীয় বহু সুযোগ সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ডিরোজিতার পরিবারও ছিল সে বঞ্চিতদের একটি। ডিরোজিও কলকাতার বিভিন্ন ইউরোপীয় গোষ্টীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন। তবে তিনি নিজেকে একজন ভারতবাসী হিসেবে মনে করতেন। ইংরেজিতে রচিত তাঁর কবিতাবলিতে এবং প্রবন্ধবলিতে তার সন্দেহাতীত প্রমাণ রয়েছে। তৎকালীন অধঃপতিত বাঙালি সমাজের উন্নতি সাধন ছিল তাঁর জীবনের মূল ব্রত। সে উদ্দেশেই তিনি ছাত্রদেরকে জিজ্ঞাসু, সন্ধিৎসু ও পরিশ্রমী করে তুলতে চাইতেন। নিম্নে ইয়ং বেঙ্গল প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা বর্ণনা করা হলো।
যুক্তিবাদী মানসিকতা : ডিরোজিও একজন পুরোদস্তুর যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আবেগের পরিবর্তে যুক্তিকে প্রাধান্য নিয়েছেন। তিনি যখন হিন্দু কলেজে যোগদান করলেন তখন থেকেই মূলত তার সমাজ ভাবনা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে শুরু করে। তিনি চারপাশের সমাজ পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে, বাংলার মানুষ আবেগপ্রবণ,তারা যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি প্রাধান্য দেয়। এর ফলে বাংলার মানুষের অধঃপাতে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী চিন্তা করে তিনি আবেগময় চিন্তার পরিবর্তে বাংলার মানুষকে যুক্তিবাদী চিন্তা করতে শেখানোর প্রয়াসে একটি দার্শনিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। আর এ দার্শনিক আন্দোলনই হচ্ছে ইয়ং বেঙ্গল দার্শনিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের আরো অংশীদার ছিলেন হিন্দু কলেজেরই আরো কিছু প্রগতিশীল শিক্ষক ও ছাত্র।
দক্ষ সংগঠক : ডিরোজিও তাঁর চিন্তাচেতনা একটি পদ্ধতিগত উপায়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। এ উদ্দেশেই তিনি একাডেমিক এসোসিয়েশন (Academic association) প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে সমাজের নানা সমস্যা এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে মুক্ত আলোচনা ও তর্কবিতর্ক অনুষ্ঠিত হতো। তিনি তাঁর স্বীয় চরিত্রের ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করে ছাত্রদেরকে কাছে টানতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ক্লাসের বাইরে ছাত্রদের সাথে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মুক্ত আলোচনা করতেন। তিনি শিক্ষক হয়েও তাদের কাছে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতেন এবং তাদেরকে সঠিক চিন্তা করতে সহায়তা প্রদান করতেন। ডিরোজিও’র ছাত্ররা পশ্চিমা মনীষী ভলতেয়ার, হিউম, লক, টমাস পেইন প্রমুখের রচনাবলি অধ্যয়ন করত এবং বিতর্ককালে প্রায়সই উপযুক্ত মনীষীদের তত্ত্ব হতে উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে, এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল ডিরোজিওর ছাত্রদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম স্নেহ এবং সমাজের প্রতি প্রগাঢ় দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার তাগিদে।
উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি : হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সবরকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ সংস্কারে নিজেকে ব্রতী করেছিলেন। এবং তাঁর শিষ্যদেরও এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। তিনি তৎকালীন সমাজের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার প্রভৃতিকে একটি উদার দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন এবং মানবসমাজে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করেন। তিনি ছিলেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। ধর্মের কোন প্রভাব তাঁর চিন্তাচেতনায় পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি সব ধর্মের প্রতি উদার ছিলেন এবং কোন ধর্মের কুসংস্কার তিনি গ্রহণ করতেন না এবং তাঁর শিষ্যদেরও এ বিষয়ে সচেতন করতেন। তিনি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু এ অনুরক্ততা তাঁর পাশ্চাত্য প্রীতি প্রমাণ করে ঠিকই
তবে সেটা বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। কারণ, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বেশিরভাগই যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক তাঁর উদার ও যৌক্তির দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে।
স্বাধীন চিন্তার উৎসাহ প্রদান : ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের দর্শন, সমাজতত্ত্ব, কাব্য এবং সর্বোপরি সমাজসংস্কারের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলেন। সে সময় তাঁরা পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউমের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে উৎসাহ প্রদান করতেন। কারণ স্বাধীনভাবে চিন্তা করেই কেবল কোন বিষয়ে নিঃসম্বিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়। তিনি তাঁর ছাত্রদের বলতেন সবকিছুর প্রতি সন্দিহান হও, অনুসন্ধান করে সংশয় নিরসন কর, তথ্য পর্যবেক্ষণের পর সত্য নির্ণয়ে তৎপর হও, নির্ণীত সত্য যখন বাস্তবের পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত অবস্থায় কার্যকর থাকে না, তখন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কে সন্দিহান হও এবং এভাবে সংশয় অনুসন্ধানকর্ম অন্তহীন ধারায় চালিয়ে যাও এভাবে ডিরোজিও তাঁর অনুসারীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে উৎসাহ প্রদান করতেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সত্যের একনিষ্ঠ সাধন কুসংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল।চিন্তাধারার অন্যতম রূপকার ডিরোজিও তাঁর স্বল্পকাল স্থায়ী জীবনের মাধ্যমে বাংলায় যে পদচিহ্ন রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। তাঁর নেতৃত্বেরই বাংলার ইয়ং বেঙ্গল নামে একটি দার্শনিক আন্দোলনের সূচনা হতে পেরেছিল। সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার ভেঙে সমাজকে সঠিক পথে চালিত করতে ইয়ং বেঙ্গলরা যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে তা সবই বলা যায়
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’র অনুপ্রেরণার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছিল।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b6-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%82-%e0%a6%ac%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*