সাহিত্য সমীক্ষা কাকে বলে? সামাজিক গবেষণায় সাহিত্য সমীক্ষার গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, সাহিত্য সমীক্ষা কী? সামাজিক গবেষণার সাহিত্য সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ
কর।
অথবা, সাহিত্য সমীক্ষার সংজ্ঞা দাও। সামাজিক গবেষণায় সাহিত্য সমীক্ষার গুরুত্ব বর্ণনা
কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : Research বা গবেষণা হলো পুনঃঅনুসন্ধান। অর্থাৎ, অপেক্ষাকৃত উন্নত পর্যবেক্ষণ, ভিন্ন প্রেক্ষিত খোঁজা এবং বাড়তি জ্ঞান সংযোজন করার শৃঙ্খল ব্যবস্থা। আর এ গবেষণা কাজ পরিচালনার জন্য গবেষককে প্রয়োজনীয় গ্রন্থাবলি পাঠ করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত হতে হয় । কোনো বিষয় সম্পর্কে গবেষণা করতে হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রচলিত জ্ঞান কোন স্তরে আছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। আর এ বিস্তারিত জানার জন্য প্রয়োজন হয় সাহিত্য সমীক্ষার ।
সাহিত্য সমীক্ষার : সদা পরিবর্তনশীল ও বিবর্তনশীল সামাজিক উপাদানকে উপজীব্য করে পরিচালিত সহজ গবেষণার ক্ষেত্রে সাহিত্য সমীক্ষাকে একটি দিক নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কোনো গবেষণাকার্য শুরু করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রচলিত যেসব জ্ঞান আছে তা জানার জন্য প্রাসঙ্গিক বই, প্রবন্ধ, জার্নাল গবেষণা প্রতিবেদন ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পাঠ পর্যালোচনা করাকে সাহিত্য সমীক্ষা বলে । George J. Mouly বলেছেন, “সাহিত্য সমীক্ষা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যা বিজ্ঞানকে নিস্ফল সমাপ্তি, বর্ণিত অনুসন্ধান পণ্ডশ্রম পূর্ববর্তী গবেষক প্রত্যাখ্যাত প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধন কৌশল এবং ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা নকশা প্রস্তুত দ্রুত গবেষণা ফলাফলের হাত থেকে অবশ্যম্ভাবী রূপে রক্ষা পেতে সাহায্য করে ।” Walter A. Borg 4, “The review of literature involves location reading and evaluating reports of search or well as reports of causal observation and opinion that are related to the individuals planed research project.”
ফিলিপস এর মতে, “সাহিত্য সমীক্ষা হচ্ছে অর্জিত জ্ঞানের বাইরে গবেষণা সমস্যাকে কিভাবে সংযোজিত করা যায় তার একটি দিক নির্দেশনা।” তাই সাহিত্য সমীক্ষার সংজ্ঞায় বলা যায় যে, একটি নির্দিষ্ট গবেষণা সমস্যার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহের জন্য প্রাসঙ্গিক গবেষণা প্রতিবেদন, বইপত্র, সাময়িকী, প্রবন্ধ, জার্নাল ইত্যাদির সুশৃঙ্খল বিশ্লেষণই হচ্ছে সাহিত্য সমীক্ষা ।
সামাজিক গবেষণায় সাহিত্য সমীক্ষার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা : বিজ্ঞানের যে কোনো শাখায়
নতুন নতুন তত্ত্ব উন্নয়নের ক্ষেত্রে সাহিত্য সমীক্ষার ভূমিকা ও অবদান সর্বজন স্বীকৃত, সদা পরিবর্তনশীল ও বিবর্তনশীল সামাজিক উপাদানকে উপজীব্য করে পরিচালিত সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে দিক নির্দেশন যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে । কেননা, গবেষণার বিষয়বস্তু নির্বাচন অনুরূপ গঠন, অনুমান নির্ধারণ, পদ্ধতি উদ্ভাবন, ফলাফল তুলনা ইত্যাদি
সর্বক্ষেত্রেই সাহিত্য সমীক্ষা প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক ভিত্তি ও প্রায়োগিক কৌশল সরবরাহে সহায়তা করে থাকে। সামাজিক গবেষণা সাহিত্য সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. গবেষণার বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ : সামাজিক গবেষণার একটি ক্ষেত্র যেমন— বস্তিকে বিভিন্ন বিষয়ে ভাগ করলে এর যৌক্তিকতা, প্রভাব, ফলপ্রসূতা ইত্যাদি দিক খুঁজে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে গবেষক যে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করবেন সে সম্পর্কে কোনো প্রচলিত জ্ঞান আছে কি না তা খুঁজে বের করতে হবে। কোনো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তখনই জানা যায় যখন বিষয়টি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণ করা হয়। এ ধারণা লাভের জন্য গবেষককে সংশ্লিষ্ট গবেষণা সংক্রান্ত পুস্তক গবেষণা প্রতিবেদনপত্র, পত্রিকা, জার্নাল ইত্যাদি পর্যালোচনা করতে হয়। গবেষণার ক্ষুদ্র বিষয়গুলোতে কোনো শূন্যতা রয়েছে কি না, তা জানতে সাহায্য করে সাহিত্য সমীক্ষা ।
২. গবেষণা সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা লাভ : George J. Mouly সাহিত্য সমীক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, গবেষণার ছাত্রছাত্রীরা সাহিত্য সমীক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য মূল্যায়নে প্রায়ই ব্যর্থ হন। সাধারণভাবে তারা সম্ভবত ধারণা করে নেয় যে, গবেষণা সমস্যা সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট জানাশুনা রয়েছে এবং যে কারণে তারা মনে করে তাদের তাৎক্ষণিক কাজই হলো সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা। এক্ষেত্রে উৎসাহী ছাত্রছাত্রীদের একটি অন্যতম কর্তব্য হলো মূল্য অনুসন্ধান কাজ শুরুর পূর্বে সম্ভাব্য সকল বিরাজমান সাহিত্য গভীরভাবে পর্যালোচনা করা। কারণ এ ধরনের উদ্যোগ হতে প্রাপ্ত জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি তাদেরকে উন্নত ও যথার্থ গবেষণা পরিকল্পনা গ্রহণ ও ফলাফল লাভে যথেষ্ট সক্ষম করে তোলে ।
৩. উদ্দেশ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে : সামাজিক ক্ষেত্রে প্রায় সকল গবেষণাতেই পরবর্তী গবেষণার জন্য সুপারিশ করা হয়। এসব সুপারিশ গবেষণার বিষয় ও উদ্দেশ্য নির্ধারণের জন্য খুবই মূল্যবান। তাই গবেষণাটি কি কি উদ্দেশ্য পরিচালিত হবে তা নির্ধারণেও সাহিত্য সমীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৪. অনুমান গঠনের ক্ষেত্রে : দারিদ্র্যের সাথে অশিক্ষার কতটুকু সম্পর্ক যুক্ত তা সাহিত্য সমীক্ষার মাধ্যমে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় । কিন্তু অশিক্ষার জন্য দারিদ্র্য বা দারিদ্র্যের জন্য অশিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন রকম অনুমান থেকে নতুন অনুমান গঠন করা যায় । এসব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহে সরাসরি সাহায্য করে থাকে সাহিত্য সমীক্ষা ।
৫. উপযুক্ত পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে : গবেষণার জন্য কোনো পদ্ধতিটি বেশি উপযুক্ত সে ব্যাপারে সাহিত্য সমীক্ষা সহায়তা করে । সংশ্লিষ্ট গবেষণাটিতে পূর্বে কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করে কতটুকু সফলতা অর্জিত হয়েছে, কোথাও কোনো শুন্যতা আছে কি না, থাকলে কেন এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহিত্য সমীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৬. তত্ত্বগত ভিত্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে : ইতঃপূর্বে সমাপ্ত সংশ্লিষ্ট গবেষণায় কি তত্ত্বগত কৌশল, গৃহীত হয়েছে এবং তার ফলাফল কি হয়েছে, তা সাহিত্য সমীক্ষার মাধ্যমে গবেষকগণ জানতে পারেন ।
৭. পুনরাবৃত্তি এড়ানোর ক্ষেত্রে : সাহিত্য সমীক্ষার মাধ্যমে পরিষ্কার বোঝা যায় কি কি বিষয়ে গবেষণা কার্যসম্পাদন হয়েছে । তাই পুনরাবৃত্তি এড়ানোর ক্ষেত্রে সাহিত্য সমীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৮. ভুলভ্রান্তি এড়ানোর ক্ষেত্রে : সাহিত্য সমীক্ষার মাধ্যমে পূর্ববর্তী গবেষণার ত্রুটিবিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি জানা যায় । তাই ভুলভ্রান্তি এড়ানোর ক্ষেত্রে সাহিত্য সমীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৯. গবেষণার সীমাবদ্ধতা অবগত হতে : সাহিত্য সমীক্ষা সংশ্লিষ্ট গবেষণার সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতার কারণগুলো জানতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
১০. নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে : সাহিত্য সমীক্ষা গবেষকের চিন্তাভাবনা সুসংগঠিত করতে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়তা করে ।
১১. তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে : সংগৃহীত তথ্যাবলি কোন পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করতে হবে, কোন পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করলে বিষয়গুলো সহজবোধ হবে সাহিত্য সমীক্ষার মাধ্যমে গবেষক তা জানতে পারেন। তাই তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলো ছাড়াও গবেষণায় ব্যবহৃত প্রত্যয়সমূহের সংজ্ঞায়ন, ব্যাখ্যা, প্রদান, ফলাফলের সম্ভাব্য প্রয়োগক্ষেত্র নমুনায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ, অন্যান্য গবেষণার ফলাফলের সাথে তুলনা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাহিত্য সমীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সূক্ষ্ম নির্ভুল প্রতিবেদন প্রস্তুতিতেও সাহিত্য সমীক্ষা সহায়তা করে । তাই গবেষণায় সাহিত্য সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ।