সামাজিক জরিপ পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর ।
অথবা, সামাজিক জরিপ পদ্ধতির সবল ও দুর্বল দিকগুলো আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক জরিপ পদ্দতির উপকারিতা ও সীমাবদ্ধতা বর্ণনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : জরিপ পদ্ধতি কোন সমস্যার বর্ণনা এবং কিভাবে এ সমস্যাকে সমীক্ষা করা যেতে পারে তার উপায় বা পন্থা নির্ধারণ করে। এ পদ্ধতির বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। তবে বহুল প্রচলিত, উপযোগী ও জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক জরিপ সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিমুক্ত নয়। অর্থাৎ সামাজিক জরিপের কিছু দুর্বল দিক রয়েছে।
জরিপ পদ্ধতির সুবিধা : নিম্নে এ পদ্ধতির সুবিধাসমূহ বিধৃত করা হলো :
১. সমস্যা নিরূপণ : জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে যে গবেষণা পরিচালনা করা হয় তাতে করে সহজেই কোন সমাজের `বিদ্যমান সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায়। যেমন- বাংলাদেশে ‘যৌতুক প্রথা’ একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে এর ভয়াবহতা, এর ধরন, কারা এর শিকার হচ্ছে, যৌতুকের কারণে নারীনির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।
২. নমনীয়তা : তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে জরিপ একটি নমনীয় পদ্ধতি । কেননা এর বিভিন্ন কৌশল রয়েছে; যেমন— পর্যবেক্ষণ, প্রশ্নমালা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি । গবেষণার উদ্দেশ্য অনুযায়ী যে কোন এক বা একাধিক কৌশল প্রয়োগ করে৷সঠিক তথ্যসংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়।
৩. কম খরচ : সামাজিক গবেষণার কাজে জরিপ পদ্ধতি অবলম্বন করলে খুব কম খরচে এবং স্বল্প সময় ও পরিশ্রমে অধিক তথ্যসংগ্রহ করা সম্ভব হয় । বিশেষকরে ডাকযোগে প্রেরিত প্রশ্নমালার ক্ষেত্রে ব্যয় খুবই কম হয় ।
৪. নির্ভুল সাধারণীকরণ : সমগ্রক জরিপে বিরাট সংখ্যক জনসংখ্যা থেকে তথ্যসংগ্রহ করা হয়। আবার সমগ্রকের প্রতিনিধিত্বশীল অংশ তথা নমুনা জরিপের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ করা হয়। ফলে এ থেকে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বা সাধারণীকরণ করা হয় তা অত্যন্ত নির্ভুল হয়।
৫. পরিকল্পনা প্রণয়ন : কোন দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত পরিকল্পনা প্রণয়নে জরিপ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী। অর্থাৎ জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক ও কল্যাণকর পরিকল্পনা প্রণয়ন সহজতর হয় ।
৬. পূর্বানুমান গঠন : পূর্বানুমান গঠনের ক্ষেত্রে জরিপ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । গবেষণার পূর্বে গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে যে পূর্বানুমান গঠন করা হয়, জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে সংগৃহীত উপাত্তের ভিত্তিতে তা যাচাই করা হয় । অর্থাৎ পূর্বানুমান গঠন ও যাচাইয়ে জরিপ পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম ।
জরিপ পদ্ধতির অসুবিধাগুলো : সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে জরিপ পদ্ধতি অত্যন্ত জনপ্রিয়, কার্যকরী এবং বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি । তথাপি এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো :
১. ব্যয়বহুল পদ্ধতি : যেখানে ব্যাপক পরিসরে জরিপ কাজ পরিচালনা করা হয়, সেখানে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে জরিপের সাহায্যে তথ্য সংগ্রহের জন্য গবেষণা চালানো উন্নত দেশে সহজ হলেও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে যথেষ্ট অসুবিধাজনক ।
২. অশিক্ষিত জনগণ : অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে জরিপ পদ্ধতিতে তথ্যসংগ্রহ করা যথেষ্ট অসুবিধাজনক । যেমন-বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগণের চেয়ে অশিক্ষিত জনগণ বেশি হওয়ায় তারা গবেষণা ও জরিপের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবনে অক্ষম । তাই তারা সঠিক তথ্য প্রদান করে গবেষণায় সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয় ।
৩. ভুল তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা : অজ্ঞতা, অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি কারণে উত্তরদাতাদের নিকট থেকে জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষকরে উত্তরদাতা ভুল উত্তর দিয়ে গবেষণার কাজকে জটিল করে তুলতে পারে। তাছাড়া নিরুত্তরজনিত সমস্যা তো রয়েছেই ।
৪. পক্ষপাতিত্ব : জরিপ পদ্ধতির ক্ষেত্রে যিনি তথ্যসংগ্রহ করেন তিনি অনেক সময় ব্যক্তিগত মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন । ফলে এক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের একটা সম্ভাবনা থেকে যায় ।
৫. দরিদ্রতা : দরিদ্রতা সামাজিক জরিপের অন্যতম প্রতিবন্ধক । যেমন- দরিদ্র ব্যক্তি সবসময় কিছু প্রাপ্তির আশায় কাজ করে । তাই যেসব ক্ষেত্রে প্রাপ্তির আশা থাকে না সেখানে তার উৎসাহ কম থাকে । ফলে সঠিক উত্তর তার কাছ থেকে অনেক সময় পাওয়া যায় না।
৬. উত্তরদাতার আবেগ অনুপস্থিতি : জরিপ পদ্ধতিতে যখন কোন গবেষক উত্তরদাতার নিকট থেকে তথ্যসংগ্রহ করেন তখন উত্তরদাতার মনোভাব সঠিকভাবে ব্যক্ত হয় না। অর্থাৎ উত্তরদাতার আবেগের যথাযথ প্রতিফলন ঘটে না।
৭. নমুনায়নের সমস্যা : নমুনায়নের সফলতা ও নির্ভরযোগ্যতার উপরই নির্ভর করে জরিপ পদ্ধতির সাফল্য। কিন্তু আধেয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানামুখী সমস্যার কারণে সঠিক নমুনায়ন কষ্টকর এবং সম্পাদিত নমুনায়ন প্রায়শই প্রতিনিধিত্বশীল হয় না ।
৮. ক্ষণস্থায়ী : জরিপ পদ্ধতির ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষণস্থায়ী হয়। কেননা অধিকাংশ সময়ই পরিবর্তনশীল বিষয়
নিয়ে জরিপ কার্য পরিচালনা করা হয়। ফলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সংগৃহীত তথ্য খুব বেশি সময় কার্যকর থাকে না ।লোচনা কর।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জরিপ পদ্ধতির মাধ্যমে কোন একটি বিষয়ের অন্তর্গত সমগ্রক সম্পর্কে একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়ার চেষ্টা করা হয় । এর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মানবসভ্যতার অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন গোষ্ঠীভিত্তিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তা কার্যকর অবদান রেখে আসছে ।