বৈষ্ণব দর্শনের দেহোত্তীর্ণ মহাপ্রেমের ধারণা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, রাধাকৃষ্ণের লৌকিক প্রেমের অন্তরালে ব্যাখ্যাত বৈষ্ণবীয় দেহোত্তীর্ণ মহাপ্রেমের স্বরূপ নিরূপণ কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় দেহ উত্তীর্ণ প্রেমের ধারণা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় প্রেমতত্ত্ব সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় প্রেমতত্ত্ব কি?
অথবা, রাধা কৃষ্ণের দেহোত্তীর্ণ মহাপ্রেম সম্পর্কে যা জানো লেখ।
উত্তর।। ভূমিকা :
মধ্যযুগের বাঙালির মনন সাধনার পরিসরে মহানপুরুষ শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা তাঁর প্রবর্তিত মতধারা মধ্যযুগের বাঙলির ধর্ম দর্শন ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে নব জোয়ারের সৃষ্টি করেছিল। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত এ মতধারা বৈষ্ণব প্রেমধর্ম বা প্রেমদর্শন নামেই আমাদের নিকট সমধিক পরিচিত। প্রেম বা প্রেমভক্তিই বৈষ্ণব মতের মূল সারোৎসার। রাধাকৃষ্ণের পরকীয়া বা লৌকিক প্রেমের অন্তরালে এ মতে ব্যাখ্যাত হয়েছে নিগূঢ় তত্ত্বকথা বা দেহোত্তীর্ণ অতীন্দ্রিয় মহাপ্রেমের ধারণা।
দেহোত্তীর্ণ সহাবে : বৈষ্ণব প্রেম দর্শনের মূল কথা দেহের মধ্য দিয়ে বিকশিত দেহোত্তীর্ণ প্রেম বা ঈশ্বর প্রেম। শ্রীকৃষ্ণ একমাত্র ঈশ্বর ও আরাধ্য। কিন্তু তিনি প্রেমময়। তাঁকে লাভ করতে হয় প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। তবে এ পরম প্রেম দেহ নিরপেক্ষ নয়। এ প্রেমের সূত্রপাত ঘটে দেহকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বিকাশের উচ্চতর পর্যায়ে তা ক্রমণ অতিক্রম করে যায় দেহের বন্ধন এবং পরিণত হয় দেহোত্তীর্ণ অতীন্দ্রিয় প্রেমে। দেহ ও আত্মা উভয়ই এ প্রেমের উপাদান দেহ ও আত্মা এতে যুগপৎ উপস্থিত। রাধা যে রূপে মুগ্ধ সেই রূপ কামনানয় দেহকে আশ্রয় করেনি। দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধও থাকেনি। দেহকে অতিক্রম করে রাধারেম পরিশেষে পরিব্যপ্ত হয়েছে আকাশে, মেঘালয়ে, যমুনার জলোচ্ছ্বাসে, এক কথায় বিশ্বপ্রকৃতির সর্বদিকে। এ প্রেমই প্রতীকী রূপ লাভ করেছে বৃন্দাবনের পরকীয়া প্রেমে। তবে এ পরকীয়া পৌকিক নয় বরং অতীন্দ্রিয়। এর সম্বন্ধ ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে। এ পরকীয়া যে তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তা অর্জন করেছে দার্শনিক প্রতীকীরূপ। যেমন শ্রীকৃষ্ণের মুরলী ধ্বনি শোনামাত্র কেউ আর ঘরে থাকতে পারে না। ‘সতী ভুলে নিজপতি, মুনি ভুলে নৌন। শুনি পুলকিত হয় তরুলতাগণও। এ ধ্বনি শোনামাত্র সবাই সবকিছু ভুলে পাগলের মতো ছুটে যায় বনের দিকে। গৃহী, সংসারী নারীর এ ছুটে যাওয়া পরপুরুষের টানে ছুটে যাওয়া নয়, অতীন্দ্রিয় প্রেমের আকর্ষণই এখানে মুখ্য।এখানে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে শ্রীকৃষ্ণের মুরলী কোনো মামুলি বাস্তব বস্তু নয়। আর ব্রজগোপীরাও সমাজের আর দশজন নারীর মতো সাধারণ নয়। এরা কেউই পরপুরুষের জন্য অপেক্ষামান লালসাবতী নারী নয়। সবাই নিষ্ঠাবান ঘরসংসারের প্রতি। আবার তারাই সাড়া দিচ্ছে সৎ, চিৎ, আনন্দের মূর্তিমান বিগ্রহ পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আহ্বানে। এ পরমপুরুষ, তিনি কখনো একদল নারী নিয়ে লীলা করেন না, করতে পারেন না। তাই দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার । প্রকৃত মানে হচ্ছে সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক আপন আনন্দেরই আস্বাদন। তত্ত্বের দিক থেকে রাধাকৃষ্ণের স্বকীয় শক্তির প্রকাশ এবং এজন্য রাধা স্বকীয়। কিন্তু পৌকিক দৃষ্টিতে রাধা অন্যের স্ত্রী, তাই লৌকিক অর্থে পরকীয়া। এ পরকীয়ার অর্থ সাধারণ্যে অলক্ষ্য, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিচার্য। এ প্রেমে এত সুখ যে, যে এসেছে সেই মজেছে, অন্য রাজ্যে যেতে চায় না। রাধাকৃষ্ণের প্রেম লোকাতীত ও অপার্থিব। এ প্রেম মিস্টিকধর্মী, একে অনুভব করতে হয় অন্তর দিয়ে। এ প্রেম চিরনবায়নযোগ্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এতে তৃপ্তির কোনো ছেদ নেই। প্রচলিত ভাষায় এর গাঢ়তা ও গূঢ়তা ব্যাখ্যা করা যায় না। এ মহাপ্রেমে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যকার সব ব্যবধান হয় তিরোহিত। এ পর্যায়ে এসে ভক্ত ভুলে যান তার স্বীয় অস্তিত্ব। একাকার হয়ে যান ভগবানের সাথে। বৈষ্ণব ভাষায় একেই বলে শ্রীরাধার আত্মনিবেদন ও আত্মসমর্পণ। বাউলরা বলেন ‘জ্যাস্তে মরা’ আর সুফি সাধকরা বলেন ‘ফানাফিল্লাহ’ ও ‘বাকাবিল্লাহ’।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, বৈষ্ণব দর্শনে রাধাকৃষ্ণের লৌকিক পরকীয়ার অন্তরালে দেহোত্তীর্ণ অতীন্দ্রিয় মহাপ্রেমই ব্যাখ্যাত হয়েছে রূপক আকারে। এ প্রেম আধ্যাত্মিক মরমি অনুভূতির ব্যাপার, সাধারণ জ্ঞানের সাধ্যাতীত। উচ্চতর পর্যায়ে এ প্রেম ঘুচিয়ে দেয় ভক্ত ও ভগবানের সব ব্যবধান, সব দূরত্ব। ভক্ত ও ভগবান মিলেমিশে হয়ে যায় একাকার। আর প্রেমের এ সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেই শ্রীচৈতন্য বলেছেন ‘মুই সেই মুই সেই’ অর্থাৎ ‘আমিই কৃষ্ণ’।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*