বাউলগানের সাহিত্যিক মূল্য নিরূপণ কর।
অথবা, বিশেষ তত্ত্ব প্রোথিত থাকলেও বাউলগানগুলো শিল্পগুণে সমৃদ্ধ আলোচনা কর।
অথবা, বাউলগানের কাব্যমূল্য বিচার কর।
অথবা, বাউলগানের সাহিত্যমূল্য পর্যালোচনা কর।
অথবা, বাউলগানের সমৃদ্ধ সাহিত্যমূল্য ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ জুড়ে আছে গান বা গীতি কবিতা। এমনিভাবে বাউলগান মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে আমাদের সাহিত্যের ভাণ্ডারকে করেছে পরিপূর্ণ। মধ্যযুগের গীতি কবিতাগুলো আজ সাধারণ মানুষের অন্তরে সাড়া জাগায় না। কিন্তু বাউল গানগুলো সাধারণ মানুষের অন্তরে শুধু সাড়াই জাগায় না, এগুলো ছড়িয়ে পড়তে চায় এপার বাংলা হতে ওপার বাংলায়। উত্তরের হিমালয় হতে দক্ষিণের তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সাগর জলে। আজ বাঙালির ঘরে এমন সন্তান নেই, যে লালন শাহের নাম শোনেনি, প্রচার মাধ্যমগুলোতে লালনের গান শোনেনি। লালন গীতির এক কলি আপন মনে গেয়ে উঠেনি
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম পাখির পায়।”
বাউলগানের মূল্যায়ন : বাউল গানের সাহিত্যিক মূল্য যে কতখানি তা নিক্তে আলোচনা করা হল :
১. সাহিত্যিক মূল্য কি : কোন সাহিত্যিকের সাহিত্য কীর্তির সাহিত্যিক মূল্য তখনই নির্ধারিত হয়, যখন তা স্থান- কাল-পাত্রভেদে যুগ হতে যুগান্তরে মানুষের মনে প্রভাব ফেলে। আজ হতে ২০০ বছর পূর্বে রচিত বাউলগানগুলো আমাদের হৃদয়কে আজও আলোড়িত করে। এগুলো শুধু তাদের সাধনতত্ত্বের ইঙ্গিত নয়, এগুলো আমাদের আজ প্রাণের কথা, মনের বাসনা। যেমন : গগন হরকরার গীত সেই বিখ্যাত গান-
‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে।’
এখানে সাধকেরা তাদের মনের মানুষ বা পরম আত্মার খোঁজ করেছেন আর রসিক যারা তারা জীবনসঙ্গীকে বুঝেছেন।
২. কাব্য বিচারের মানদণ্ড : কাব্য বিচারের প্রধান মাপকাঠি অনুভূতি। কাব্যের দুটি ধর্ম- সংগীতধর্ম। বাউল গানেও এ চিত্র ধর্মীতা ও সংগীতধর্মিতা রক্ষিত হয়েছে। তাই লালনগীতির তত্ত্বটুকু বাদ দিলেও যা থাকবে তা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতির জন্য কাব্য বলে স্বীকার্য ।
৩. বাউলগানের কাব্যরস : ব্যক্তিগত ভাব ও অনুভূতি যখন একটি সর্বজনীন রূপ ধারণ করে, তখন তার মধ্যে রস সৃষ্টি হয়। এ রসসিক্ত ভাব ও অনুভূতি যখন উপযুক্ত ভাষায়, অলংকার ও ছন্দে প্রভৃতিতে যুক্ত হয়ে ব্যক্ত হয় এবং চিত্তরস সঞ্চার করে তখনই তো কাব্যে পদবাচ্য হয়। সমুন্নত কল্পনা, বিপুল আবেগের সংহত গভীরতা ও প্রকাশের অনবদ্য কৌশলকেই কাব্য বিচারে উৎকৃষ্ট মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। আধুনিক সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল, ভাষা, অলংকার, ছন্দ ইত্যাদিকেও ধরা হয় । বাউলগানে এগুলো পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান।
৪. বাউল গান মাটি ও মানুষের গান : আধ্যাত্মিক ধর্মকেন্দ্রিক এ সাহিত্য লোক জীবনের কথা মূল্য হয়েছে।লোকজীবনের কথা আছে বলে বাউলগান সাহিত্যিক মূল্যের দাবিদার। গীতিকার, উপমা ইত্যাদি যেমন আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও উন্নত করেছে, এ গানগুলো মাটি ও মানুষের। মানুষের গান চিহ্নিত হওয়ায় অনন্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ, সাহিত্য যদি সমাজজীবনের দর্পণ হয়, তবে বাউলগীতি সমাজের সদস্য তথা মানব মনের নিগূঢ় তত্ত্বকে আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তুলে ধরেছেন বিধায় তা অবশ্যই সাহিত্য ও শিল্পগুণমণ্ডিত। বাউলগীতির সাহিত্যিক মূল্য বিচার করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের সংজ্ঞাটি প্রনিধানযোগ্য-
অনন্ত হতে আহরী বচন
আনন্দ লোক করি বিচরণ
গীতি রসধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধূলি জালে ।
তাই স্বীকার্য যে, মানুষের আবেগ, অনুভূতি, আনন্দ, কল্পনা, মন-মানসিকতা ইত্যাদির প্রকাশ যদি সাহিত্যে থাকে, তা গীতিধর্মী হলেও সাহিত্যের দাবিদার।
৫. বাউলের ধর্ম : বাঙালির ধর্ম বিশ্বাস, আধ্যাত্মিক জগৎ ও জীবন সম্বন্ধীয় মনোভাব বাউলগানে প্রতিফলিত হয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির ধর্মের অন্তগূঢ় স্রোতধারা তার সাধারণ বৈচিত্র্যময় স্বরূপের সম্যক পরিচয় এই পলি সঙ্গীতগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে বাঙালির একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্জীবনের রসসিক্ত অভিব্যক্তি আছে। এ ধর্ম সম্প্রদায় আর্য, অনার্য, হিন্দু, বৌদ্ধ ও সুফি ভাবধারার সমন্বয়ে গঠিত বাংলার নিজস্ব একটি ধর্ম সম্প্রদায়। এ ধর্ম অভিজাত সম্প্রদায়ের ধর্ম নয়, এটি জনসাধারণের ধর্ম।
কোনো
৬. সীমাবদ্ধতা : বাউলগানগুলোর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে দেখা যায় এর গভীর সীমাবদ্ধতা এবং এতে বৈচিত্র্যের অভাব আছে। এ গানের কতকগুলো প্রচলিত স্তর বা ধারা আছে। সকলেই কম বেশি সেই স্তরের অনুক্রমে অগ্রসর হয়েছে। বিষয়বস্তুর এ সীমাবদ্ধতার জন্য বাউলগানে কিছুটা একঘেয়েমি বর্তমান। একই বিষয় নিয়ে সকলে গান রচনা করেছেন, মূলে তত্ত্ব ও সাধনায় ঐক্য থাকায় বক্তব্য প্রায় একই হয়েছে। কেবল ভাষা ও উপস্থাপনের কৌশলের মধ্যেই যা প্রভেদ। এতে একের গান হতে অন্যের গানের যা কিছু পার্থক্য সূচিত হয়েছে। তাই দেখা যায় গুরু বন্দনার পদ, মনের মানুষের পদ প্রভৃতি ভাব ও তত্ত্বের দিক হতে মূলত প্রায় সবাই সমান।
৭. জাতিভেদ প্রথা : বাউলদের কোনো জাতিভেদ নেই। বাউলেরা এ জাতিভেদ বুদ্ধিহীন মানবতার সুউচ্চ শিখরে বসে এ সুললিত গানগুলো গেয়েছেন। তাই লালন শাহের কণ্ঠে শুনি-
“সবলোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয়, জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারী লোকের কি হয় বিধান।”
৮. বিষয়বস্তু : বাউল ধর্মের বিষয়বস্তু বা প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাথে জড়িত মানবিক ভাবানুভূতি অর্থাৎ, আশা-আকাঙ্ক্ষা আনন্দ-বেদনা নৈরাশ্যের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রকাশকে সাহিত্যের সীমানা থেকে বাদ দেওয়া যায় না। গুরুর নিকট দৈন্য সাধন ভজনে অক্ষমতার জন্য সাধন ব্যক্তিগত বিচিত্র অভিজ্ঞতা প্রভৃতিই এ গানগুলোর উপজীব্য এবং ভাবানুভূতির মাধ্যমে কারুণ্য ও মাধুর্য আছে। তাই এর সাহিত্যাংশ প্রাণের এমন সহজ সরল, অকপট অভিব্যক্তিতে একটি মনোরম সাহিত্য রসের আস্বাদ আছে। এটি একটি বিশিষ্ট সাহিত্যরস। এদিক থেকে এ গানগুলো বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য সাধারণ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্পদ ।
৯. বৈশিষ্ট্য : বাউলগানের বিভিন্ন ভাব আছে। যাকে বাউলগানের বৈশিষ্ট্যও বলা যায়। এসব বৈশিষ্ট্য যা ভাবের মধ্যদিয়ে বাউলগানের অন্তর্নিহিত ভাবতত্ত্ব প্রকাশ করেছে। বাউলগানের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নি।প্রদান করা হলো : (১) আত্মাতত্ত্ব, (২) মন, (৩) মনের মানুষ, (৪) গুরু তত্ত্ব, (৫) দেহতত্ত্ব, (৬) মারফতী, (৭) খোদাতত্ত্ব, (৮) সৃষ্টিতত্ত্ব, (৯) কৃষ্ণপ্রেম, (১০) সূক্ষ্মধর্ম। বাউল গানের এ যে অন্তর্নিহিত ভাবতত্ত্ব বা বিশিষ্ট্যতা পর্যালোচনা শেষে এ মমার্থ পাই যে, বাউল মূলত আত্মিক লোকের অধিবাসী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, অন্তরে অন্তরে সকল মানুষের যুগের ক্ষেত্রে এ চিত্তলোক বাউলেরা এ চিত্তলোকের সাধনায় মগ্ন।
“আমার বাড়ীর পাশে আরশী নগর।
সেথায় এক পড়শি বসত করে”
১০. অলংকারের প্রয়োগ : শব্দ ও অর্থগত ব্যঞ্জনায় যা শব্দালংকার ও অর্থালংকার নামে পরিচিত বাউল গানে তার প্রচুর দৃষ্টান্ত মেলে। শব্দালংকারের মানে নানা প্রকার অনুপ্রাস যমক, শেষ ও ব্যঙ্গোক্তি এবং অর্থালংকারের মধ্যে উপমারূপক উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি দৃশ্যমান।
১১. উপমা : বাউল কবিরা সংসারের এবং তাদের চারপার্শ্বের বাস্তববস্তুগুলোকে উপমায় নিয়ে এসে বা দৃষ্টান্ত প্রয়োগে জীবনের সমস্যাগুলোকে চমৎকার রূপ দিয়েছেন। সর্বজন জ্ঞাত সাধারণ বিষয়। যেমন : মাছধরা, জমি চাষ করা, খেজুর গাছ কাটা ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারগুলোকে বাউল কবিগণ নিজেদের গানের বিষয়ভূত করেছেন। তারা উপমা ব্যবহারে গ্রাম অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেও তাদের উপমার আধুনিকতার ছাপ দেখা যায়। যেমন-
বনের পশু হনুমান
রাম বিনে তার নাই ধিয়ান।
দেহতত্ত্বে জটিলতা বাউলেরা নানা উপমায় তুলে ধরেছেন। যেমন-
ছয় রিপুরে বশ করিয়া
আলার নামে পেরাক দেও আঁটিয়া ।
ভজন সাধনের পদগুলোতে বাউলরা আত্মনিবেদিত। আত্মনিবেদনের ভাষা কোমল ও বেদনার্ত –
বিনা মাঙ্গায় কত ধন দিয়াছিলে মোরে।
এখন আর কোন ধন চাই না গুরু
চরণ দাও আমারে।
১২. রূপকের প্রয়োগ : রূপকের মাধ্যমে কথা বলা বা বর্ণনা দেওয়া সাহিত্যের একটি বিষয়। বাউল গানে সকল কথাই রূপকের মাধ্যমেই তারা অচিন পাখি মনের মানুষ খাঁচা পরখাতা প্রকৃতিকে জানার সাধনা করেছেন। তাই বাউলগণ এক ধানে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন রূপক ও উপমা ব্যবহারের ফলে যা অন্তর্নিহিত ভাবতত্ত্ব আবিষ্ট হয়েই সাহিজ ও কাব্য মূল্য সম্পন্ন হয়ে শিল্পমণ্ডিত হয়েছে।
১৩. চিত্রকল্প : বাউল গানে অপরূপ চিত্র ব্যবহারিত হয়েছে। যেমন-
(১) কোন সুতোঁ সাঁই করেন এই ভাবে।
দেখ সে আপনি বাজায় আপনি মজে সেই রবে।
(২) জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়
ধরতে গেলে হাতে কে পায়, (পদ-৬)
১৪. ধ্বনি মাধুর্য : বাউল গানে চিত্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গে সংগীতময়তা বা ধ্বনি মাধুর্যের মহিমাও অসাধারণ –
নড়ে চড়ে ঈশান কোণে
দেখতে পাইনা ঐ নয়নে, (পদ-৫)
এখানে ‘ন’ ধ্বনি পাঁচবার আবৃত্ত হয়ে বৃত্তানুপ্রাসে সৃষ্টি করেছে।
এই মানুষে আছে রে মন,
যারে বলে মানুষ-রতন,
লালন বলে, পেয়ে সে ধন পারলাম নারে চিনতে।………. (পদ-১০)
মন, রতন, ধন এর অন্ত্যমিল তথা অন্ত্য অনুপ্রাস।
১৫. ব্যঞ্জনার চিত্র : বাউল গানে ব্যঞ্জনার চিত্রকেও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেমনঃ
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম পাখির পায়।
আট কুঠরি নয় দরজা আঁটা।
মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা,
তার উপরে আছে সদর কোঠা
আয়না মহল তায় (পদ-১৩)
এখানে শরীর যেন খাঁচা আর আত্মা যেন অচিন পাখি- দুটি উৎকৃষ্ট উৎপ্রেক্ষার নিদর্শন। আট কুঠরি, নয় দরজা, ঝলকা কাটা, সদর কোঠা, আয়না মহল প্রভৃতি রূপক |
১৬. বাউলগানের ছন্দ : ছন্দের ব্যবহার গানের ক্ষেত্রে কবিতার মতো ধরাবাধা নিয়মে সবসময় চলে না। তারপরও কোনো কোনো বাউলজানে নিখুঁত ছন্দের পরিচয়ও মেলে। যেমন-
ক্ষ্যাপা, তুই না জেনে তোর আপন খবর
যাবি কোথায়।
আপনি ঘর না বুঝে বাইরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায় (পদ-৮)
লালন শাহ রচিত উপরিউক্ত চরণ দুটি স্বরবৃত্তছন্দের নিখুঁত চলন পাওয়া পায়। এতে প্রথম চরণের শুরুতে ৩ মাত্রার ও দ্বিতায় চরণের শুরুতে ২ মাত্রায় অতি পট আছে। বাকি সমস্ত চরণে ৪ মাত্রার পূর্ণ কার্য বিদ্যমান।
১৭. রস : বাউলেরা তাদের গানের মধ্য দিয়ে সাধন ভজন করে মনের মানুষ তথা পরমাত্মাকে পেতে চায়। কিন্তু তাদের সাধনভজন যথাথ হচ্ছে না এবং মনের মানুষকে স্পর্শ করতে না পারায় তাদের সংগীতে বেদনার সুর উচ্চারিত। ফলে বাউল সংগীতে প্রধান রস করুণ সুর।
১৮. শব্দ : বাউলেরা তাদের তত্ত্ব কথা বোঝাতে গ্রামীণ দৈনন্দিন জীবনের উপমা উপকরণ ব্যবহারে যেমন সহজ সরল শব্দ ব্যবহার করেছে, তেমনি তত্ত্বকথা বোঝাতে কিছু প্রতীকধর্মী শব্দ ব্যবহার করেছে। তাছাড়া হিন্দু মুসলিম ঐতিহ্য থেকে ব্যবহৃত হয়েছে শব্দ।
মুসলিম ঐতিহ্য : নিরঞ্জন, সাঁই, আসমান, ব্যঞ্জনা, সুন্নত, তসবি, মোকাম, নাসুত, লাহুত, মালকুত, বেদাতি ।
হিন্দু ঐতিহ্য : রাম, হনুমান, গঙ্গা, হরি, বেদ, বেদন্তি, শ্মশান, তীর্থ, বামন, পৈতা।
প্রতীক : পড়শী (পরমাত্মা), চাবি (গুরু), মোগ (ধর্মজ্ঞান), অচেনা (পরমাত্মা), অচিন পাখি (আত্মা), পাঁচ ভূত (বাহু)।
তৎসম : হস্ত পদ, ন্ধ নীর।
গেত তাত্ত্বিক : দ্বিদল পদন, ত্রিবেণী।
লোকজ : গাজি, জেলে, দড়া, মিছরি, গলি, ঘোঙা।
১৯. প্রেমতত্ত্ব : বাউলদের সাধনা কাম-বাসনা বর্জিত নয়, কামের কথা প্রকাশে তাদের ভাষা বিষয়ানুগ৷৷
বলব কি সে প্রেমের কথা
কাম হইল প্রেমের নাতা,
কাম ছাড়া প্রেম যথা তথা
নাইরে আগমন।
২০. দৈনন্দিন বিষয় বর্ণনা : বাউলেরা গ্রাম্য জীবনের দৈনন্দিন বিষয়গুলোর মাধ্যমে তাদের তত্ত্বকথা ব্যক্ত করেছেন, যা শিল্পোত্তীর্ণ। যেমন :
(১) ধর্ম-মাছ-ধরব বলে নামলাম জলে,
ভক্তি-জাল ছিড়ে গেল।
(২) এমন চাষা বুদ্ধি নাশা তুই,
কেন দেখিল না আপনার ভুঁই।
২১. বাউলদের খেদোক্তি : আত্মজ্ঞান না থাকায় বাউলদের যে খেদোক্তি তা সরলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন :
(১) আপনার আপনি যদি চেনা যায়,
তবে তারে চিনতে পারি সেই পরিচিত।
(২) লালন মরল জল পিপাসায়,
থাকতে নদী মেঘনা।
২২. পরমার খোঁজ : বাউলগানে পরমাত্মার খোঁজে বাউলদের নিরন্তর যে ভাবনা তাঁর শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যেমন :
(১) আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ীর পাশে আরশী নগর
এক পড়শী বসত করে।
(২) আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে,
তারে জনম ভর একবার দেখলাম নারে।।
২৩. পরবর্তী সাহিত্যে এর প্রভাব : বাউলগানের সাহিত্যিক মূল্য বেশি থাকায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাউল পদাবলি অনুসারে কিছু গান রচনা করেছেন। যেমন :
(১) আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাই নি
আমি বাহির পানে চোখ মেলেছি
ভেতর পানে চাইনি।
(২) আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
আমি হেরি তাই সকল খানে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বাউল গানগুলো সুপ্রাচীনকাল থেকে অন্তঃসলীলা নদীর ন্যায় বাংলার মানস চেতনাকে সরস করেছে। সর্বোপরি বাউলের একতারার উদাসী সুর বাঙ্গালীর মানস্য লোকে অদ্যাবধিও জাগ্রত রয়েছে। এ যেন বাংলার নিজস্ব একটি সমাজ। এখানেই এর সর্বজনীতা এবং সাহিত্যিক মূল্য নিহিত রয়েছে।