নারী শিক্ষা ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান আলোচনা কর।
অথবা, নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার অবদান আলোচনা কর।
অথবা, নারী শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়ার ভূমিকা মূল্যায়ন কর।
অথবা, নারী জাতীর উন্নয়নে বেগম রোকেয়ার কি ভূমিকা ছিল? তোমার নিজের ভাষায় লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : নারী শিক্ষা ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া একজন মহীয়সী নারী। বাংলার অৱহেলিত, বঞ্চিত, অজ্ঞ, সামাজিকভাবে অসচেতন নারীদের আলোর পথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান অপরিসীম। সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি মুসলিম নারীজাগরণের উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বেগম রোকেয়া তাঁর জীবনের ব্রত হিসেবে মুসলিম নারীসমাজের উন্নয়ন ও কল্যাণকে গ্রহণ করেছিলেন। অবরোধবাসিনী নারীদের কল্যাণে অবিভক্ত বাংলায় মানুষ যার নাম শ্রদ্ধার সাথে আজও স্মরণ করে তিনিই হলেন বেগম রোকেয়া, বৃহৎ নারীসমাজের প্রগতি ও জাগরণের মশাল হাতে কাজ শুরু করেন। তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নারীসমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন, যাতে নারীরা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে না যায়।
নারী শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে বেগম রোকেয়ার অবদান : নিম্নে নারী শিক্ষা ও সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর মাত্র পাঁচ জন ছাত্রীকে নিয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত ভাগলপুরে মেমোরিয়াল গার্লস
স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পারিবারিকভাবে বাধা পেয়ে পরবর্তীতে তিনি এ স্কুলটিকে কলকাতায় স্থানান্তর করেন। ১৯১১ সালে কলকাতায় স্কুলটিকে স্থায়ীভাবে স্থাপন করে মুসলিম নারীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। বেগম রোকেয়া সে সময় প্রত্যেক মুসলিম ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বুঝান, যাতে মেয়েরা তাদের পারিবারিক গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে নিজেদেরকে অজ্ঞতা, অশিক্ষা থেকে মুক্ত করতে পারে। তিনি ১৯২৯ সালে কলকাতায় মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেন। স্কুলে মেয়েদের শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে রোকেয়া বলেছেন, “মেয়েদের সে ধরনের শিক্ষা দান করতে হবে যাতে করে তারা সংসার জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীরূপে গড়ে উঠতে পারে। তাই কেবল পুঁথিগত বিদ্যাই নয়, মেয়েদের নানাভাবে দেশের সেবা ও পরোপকার ব্রতীতে উদ্বুদ্ধ করে গড়ে তোলা।” মুসলিম নারীসমাজে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার প্রচলন করাই ছিল রোকেয়ার উদ্দেশ্য। তিনি মেয়েদের নিজেদের অধিকার আদায় করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সামাজিক কুপ্রথা, কুশিক্ষা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বেগম রোকেয়ার মতে, “শিক্ষাবিস্তারই এসব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ।
অন্ততপক্ষে, বালিকাদেরকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতেই হবে। শিক্ষা অর্থে প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি, গোটাকতক পুস্তক পাঠ করতে বা দু দুটি কবিতা লিখতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সে শিক্ষা যা তাদেরকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করবে। শিক্ষা মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিদ হওয়া চাই। তাদের জানা উচিত যে, তারা ইহজগতে কেবল সুদৃশ্য শাড়ি,
ক্লিপ ও বহুমূল্য রত্নালংকার পুতুল সাজানোর জন্য আসে নি, তাদের জীবন শুধু পতিদেবতার মনোরঞ্জনের নিমিত্তে উৎসর্গ হওয়ার বস্তু নয়। তারা যেন অন্নবস্ত্রের জন্য কারও গলগ্রহ না হয়।” রোকেয়া জ্ঞান অর্জন করার জন্য পাশ্চাত্য নারীসমাজের আদর্শ গ্রহণ করতে বলেছেন। কিন্তু তাদের জীবনযাপন প্রণালীর জটিলতা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেন, “দূরের ঢোল শুনতে শ্রুতিমধুর। সভ্যতা ও স্বাধীনতার লালনভূমি লন্ডন নগরীতে শত শত ডেলিশিয়া বধ কাব্য নিত্য অভিনীত হয়। হায় রমণী! পৃথিবীর সর্বত্রই অবলা।” রোকেয়া কেবলমাত্র শিক্ষার প্রসার ঘটাতেই চান নি, তিনি সমাজসংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষাকে বিবেচনা করেছেন। বেগম রোকেয়া বলেছেন, – শিক্ষার অর্থ কোনো সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের অন্ধ অনুকরণ নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়েছেন, সে ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা। —ঈশ্বর আমাদেরকে হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ, মন এবং চিন্তাশক্তি দিয়েছেন।যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হট্টপদ সবল করি, হস্ত দ্বারা সৎকার্য করি, চক্ষু দ্বারা মনো.যাগসহকারে দর্শন করি, কর্ণ দ্বারা
মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করি এবং টিশক্তি দ্বারা আরো সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে শিখি তাই প্রকৃত শিক্ষা।” নারী শিক্ষার ব্যাপারে রোকেয়ার ধারণা ছিল অত্যন্ত প্রখর ও স্বচ্ছ। বেগম রোকেয়ার সামগ্রিক নারীজাগরণের দর্শন
সম্পর্কে যে পরিচয় তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে তা হলো, “এ বিশাল জগতে কোনো দেশ, কোনো জাতি, কোনো ধর্ম নারীকে কিছু মাত্র অধিকার দান করা দূরে থাকুক, নারীর আত্মাকেও স্বীকার করে নি। একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দান করেছে। কিন্তু ভারতবর্ষে সে মুসলিম নারীর দুর্দশার অন্ত নেই। মুসলিম নারীসমাজ আত্মসচেতন হোক, শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানকর্মে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে পুরুষের মতো নারীরাও যাতে সমান অবদান রাখতে সক্ষম হয়, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। তিনি নারী ও পুরুষকে সমানভাবে দেখতেন। একজন পুরুষ যা করতে পারেন একজন নারীও সেভাবেই করতে পারে। পুরুষের চেয়ে নারীর যোগ্যতা কোনো অংশেই কম নয়।
আঞ্জুমানের মাধ্যমে বেগম রোকেয়া দরিদ্র অসহায় নারীদের শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং তাকে বিধবা মহিলাদের কর্মসংস্থানের অগ্রদূত বলা হয়। অবরোধবাসিনী নারীদের তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পর্দাপ্রথাকে নারীর স্বাভাবিক পবিত্রতা রক্ষার মাধ্যম বলে উল্লেখ করেছেন, যার সাথে উন্নতি ও শিক্ষার কোনোরকম বিরোধ নেই। তিনি নারী অধিকার ও নারী শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, “আমরা লেডি
কেরানি হতে আরম্ভ করে লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি জজ সবই হব। পঞ্চাশ বছর পর লেডি ভাইসরয় দেখে পুরুষের চোখে ধাঁধা লাগবে।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে একথা বলতে পারি যে, বেগম রোকেয়া শুধু শিক্ষার প্রসারই চান নি, বরং শিক্ষার মাধ্যমে সমাজসংস্কারও চেয়েছিলেন। বাঙালি মুসলিম নারীদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে আলোর পথে আনয়ন করতে বেগম রোকেয়ার অবদান অপরিসীম। বেগম রোকেয়ার জন্যই আজ মুসলিম নারীসমাজ অবরোধের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে রোকেয়ার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর মৃত্যুর পর স্টেটসম্যান পত্রিকায় মন্তব্য করেছিল, “She devoted her life and all the resources to the cause of education for girls.” নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া জীবনের শেষ মুহূর্তটুকু পর্যন্ত ব্যয় করেন।