মাদার তেরেসার জীবনী, বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ড ও তাঁর অবদানসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, সমাজসেবক হিসেবে মাদার তেরেসা সম্পর্কে মূল্যায়ন কর।
অথবা, মাদার তেরেসার জীবনী, বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ড ও অবদান সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, মাদার তেরেসার সমাজসেবা মানব কল্যাণ সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ইতিহাসে যে সকল মহিয়সীর নাম চিরউজ্জ্বল ও চিরভাস্বর হয়ে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাদার তেরেসা। তিনি হলেন মানবতার এক উজ্জ্বল প্রতীক। মানব সেবার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন। মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কাজ ও সেবা প্রদানের জন্য তিনি চিরকুমারীত্ব বেছে নিয়েছিলেন। নিজের সুখশান্তি বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন মানব সেবায় ব্যয় করেছেন। আজীবন তিনি গরিব, দুঃখী ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দরিদ্রদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা যে কত গভীর তা তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যেই আমরা লক্ষ্য করি। যেমন- নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে ভোজসভার আয়োজন না করে সে অর্থ দরিদ্রদের মাঝে ব্যয় করার জন্য তিনি নোবেল কমিটিকে অনুরোধ করেন। আর এভাবেই সত্যিকার অর্থে তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাতা হয়ে উঠেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : আলবেনিয়ার স্কপিতে ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট মাদার তেরেসা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম অ্যাগনেস গোনজল বোজাঝিউ। তাঁর পিতার নাম বোজাঝিউ এবং মায়ের নাম দ্রানাফিল বার্নাই। পিতামাতার তিন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার ছোট ছিলেন। তাঁর নাম মাদার তেরেসা রাখা হয় তখনি যখন বড় হয়ে তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। একটি সরকারি স্কুলে মাদার তেরেসা তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মনোযোগ। ১৯২৮ সালে তিনি আয়ারল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি রোমান ক্যাথলিক নান (Roman Catholic Nun) হিসেবে এক গির্জায় দায়িত্ব পালনে রত হন। এরপর ১৮ বছর বয়সে ১৯২৯ সালে তিনি ভারতে আসেন। সেখানে দার্জিলিংএ তিনি তিন বছর সন্ন্যাসিনী হবার প্রশিক্ষণ নেন ‘লরেটা সিস্টার্স’ নামে এক খ্রিস্টান মিশনারী দলের সদস্য হিসেবে। সেই সাথে বাংলা ভাষাও তিনি তাঁর কাজের সুবিধার জন্য শেখেন। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি কলকাতার সেন্ট স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করে যান। এরপর তিনি সেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। দুস্থ মানুষদের জন্য তিনি কাজ করতে থাকেন। ১৯৪৬-৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ড করেছেন কলকাতায়। তাঁর মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। তিনি ১৯৭১ সালে লাভ করেন ২৩তম পোপ জনশক্তি পুরস্কার। এরপর তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৭৯ সালে। এছাড়াও তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘ভারতরত্ন’ লাভ করেন ১৯৮০ সালে। তিনি মিশনারিজ অব চ্যারিটি এর প্রধানের পদ ১৯৯০ সালে ছেড়ে দেন। কারণ এ সময় থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি দেখা দেয়। পরবর্তী বছরগুলো তাঁর অসুস্থতার মধ্য দিয়েই কাটতে থাকে। অবশেষে এ মহান মহিয়সী নারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মাদার তেরেসার বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ড ও অবদান : মাদার তেরেসা মানুষের সেবার জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন। নিম্নে তাঁর বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ড ও অবদান সম্পর্কে আলোচনা হলো:
১. দরিদ্রের বন্ধু : তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে দরিদ্রের বন্ধু। দুঃখী, নিপীড়িত, রোগক্লিষ্ট মানুষের আর্তনাদ তিনি যেখানেই শুনেছেন সেখানেই তিনি ছুটে গিয়েছেন। দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য তিনি সামগ্রিকভাবে চেষ্টা করেছেন। দরিদ্রদেরকে তিনি আর্থিক সাহায্যও করেছেন। তার নোবেল বিজয়ের অর্থ তিনি নিজের ভোগবিলাসে ব্যয় করেন নি, তাও তিনি ব্যয় করেছিলেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য। ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত মানুষ দেখলে তাঁর হৃদয় হাহাকার করে উঠতো। তখন তিনি ছুটে গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। যার কারণে তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ পরিবর্তনের মধ্য
দিয়েই তিনি গরিবদের সেবাদাত্রীরূপে আবির্ভূত হন। ভালোবাসা ও সহমর্মিতা দিয়ে তিনি আপন করে নেন গরিব, দুঃখী মানুষদের। নিজের সকল লোভলালসা ত্যাগ করে তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পালন করেন এক স্বর্গীয় দূতের ভূমিকা।
২. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কোটি কোটি লোক পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ছুটে যান। মাদার তেরেসা সে সময় এ সকল
শরণার্থীদের সেবা প্রদানের জন্য বিশেষভাবে এগিয়ে আসেন।
৩. বাংলাদেশ মিশনারিজ অব চ্যারিটির শাখা স্থাপন : ১৯৭২ সালে মাদার তেরেসা সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে তখন থেকেই মিশনারিজ অব চ্যারিটির সেবা শুরু করেন। ঢাকার ইসলামপুরে এর প্রথম শাখা গড়ে তোলা হয় ৷
৪. শিশু ভবন ও নবজীবন আবাস প্রতিষ্ঠা : অনাথ শিশুদের আশ্রয়স্থল হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শিশু ভবন। অনাথ এতিম শিশুদের রাস্তা থেকে তুলে এনে তিনি তাঁর শিশু ভবনে আশ্রয় দিতেন। আর ‘নবজীবন আবাস’ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য।
৫. শিক্ষাক্ষেত্র : গরিব, দুঃখী, অনাথ, এতিম শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য কলকাতার নোংরা বস্তিত্বে তিনি তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। চেয়ার-টেবিল নয়, নোংরা মাটিতে বসেই তিনি অক্ষরজ্ঞান দান করতে লাগলেন বস্তির শিশুদেরকে।
৬. প্রেম নিবাস প্রতিষ্ঠা : কুষ্ঠ রোগীদের আশ্রয় প্রদানের জন্য তিনি ভারতের টিটান গড়ে ‘প্রেম নিবাস’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে কুষ্ঠ রোগীদেরকে দেয়া হতো অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সেবা। মাদার তেরেসা নিজ হাতে রোগীকে পরিষ্কার করে গোসল করিয়ে দিতেন । প্রেম নিবাস কুষ্ঠ রোগীদের জন্য প্রকৃত অর্থেই এক ভালোবাসার আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
৭. দরিদ্রদের অর্থ সহায়তা : তাঁর মহান কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘নোবেল’ পুরস্কারসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পুরস্কৃত করা হয়। এসব পুরস্কারের অর্থ তিনি নিজে ব্যয় করেন নি। সব অর্থই তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাহাযার্থে অকাতরে ব্যয় করেছেন।
৮. দুর্ভিক্ষের সময় সাহায্য : তিনি সাহায্য করার জন্য সব সময় দাঁড়িয়েছেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের পাশে। তাঁর জীবনের প্রধান কাজই ছিল ক্ষুধার্তকে অন্নন্দান, তৃষ্ণার্ত মানুষের তৃষ্ণা মিটানো, বস্ত্রহীনদের বস্ত্রদান, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় প্রদান। কলকাতার দুর্ভিক্ষসহ বিভিন্ন সময় তিনি গরিব, দুঃখীদের সাহায্য করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই যে, আলবেনীয় বংশোদ্ভূত এ মহান মহিয়সী তাঁর জীবনের সবটুকু সময়ই মানব সেবায় ব্যয় করেছেন। তাঁর চোখে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বলতে আলাদা কোনো কিছু ছিল না। অকাতরে তিনি সবার জন্য সেবা প্রদান করে গেছেন। তিনি ছিলেন দরিদ্রদের বন্ধু, মাতা। এ মহান মানবী পৃথিবীর মানুষের মন জয় করেছিলেন, তাঁর সেবা, আদর ও ভালোবাসা দিয়ে। সারা বিশ্বের মানুষ যার জন্য আজও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং আজীবন করবে। মহান হৃদয়ের মহিয়সীর মৃত্যু হলেও তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি হয়ে থাকবেন চির অমর।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a7%8d/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*