এথনোগ্রাফিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য ও কৌশলগুলো লেখ। এথনোগ্রাফিক পদ্ধতির সুবিধা সীমাবদ্ধতাগুলো আলোচনা কর।
অথবা, এথনোগ্রাফিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য ও কৌশল কী কী? এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো আলোচনা কর।
অথবা, এথনোগ্রাফিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য উল্লেখপূর্বক এর সবল ও দুর্বল দিকসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, এথনোগ্রাফিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর। এর সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : আদিম মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহের জন্য নৃবিজ্ঞানীগণ সর্বপ্রথম এথনোগ্রাফিক অধ্যয়ন বা অনুসন্ধানের সূচনা করেন। ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানী রেডফিল্ড এবং রিভার্স সর্বপ্রথম সমাজ গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে গিয়ে এ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। তাঁরা এ পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষুদ্র সমাজের গভীর সমীক্ষার জন্য দীর্ঘদিন গবেষণার ক্ষেত্রে অতিবাহিত করে গবেষণাধীন সমাজের বিশদ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যসংগ্রহ করেন। তবে এ পদ্ধতির সাথে ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানী রেডক্লিফ ব্রাউন এবং ম্যালিনোস্কির (Radcliffe Brown and Malinowski) নামও বিশেষভাবে জড়িত। কেননা তাঁরা উভয়েই নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতি অবলম্বনে যথাক্রমে আন্দামান দ্বীপবাসী এবং ট্রবিয়ান্ড দ্বীপবাসীদের মধ্যে গবেষণা পরিচালনা করেন। তাঁদের প্রত্যক্ষানুসন্ধান পরবর্তী কালে বহু সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীকে এ পদ্ধতি অবলম্বন করে সমাজ গবেষণায় ব্রতী হতে অনুপ্রাণিত করে।
এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানের বৈশিষ্ট্য : এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানের কতিপয় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যান্য গবেষণা অনুসন্ধান থেকে ভিন্ন। নিম্নে এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো :
১.সরেজমিনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হয় বলে এখনোগ্রাফিক অনুসন্ধান দীর্ঘমেয়াদি প্রকৃতির হয়।
২. এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধান জরিপের মতো কোনো কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নমালার সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করা হয় না বরং গবেষণাধীন এলাকার জনগণের ভাষা সংস্কৃতি, প্রথা, মূল্যবোধ, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ও বিধিবিধান প্রভৃতির বর্ণনা পেতে স্বাভাবিক জীবনধারাকে পর্যবেক্ষণ করে অনুসন্ধান কাজ পরিচালিত হয় ।
৩. এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গবেষককে গবেষণাধীন এলাকার জনগণ ও তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে ঘনিষ্ঠ ও একাত্ম হয়ে তাদের ভাবানুভূতি ও কর্মপ্রক্রিয়ার ধাঁচে তথ্য সংগ্রহ করেন।
8.এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানে তথ্য সংগ্রহের কৌশল হিসেবে সাক্ষাৎকারগ্রহণ, ঘটনা জরিপ, পর্যবেক্ষণসহ অন্যান্য কৌশল ব্যবহৃত হয়।
৫. সাধারণত ক্ষুদ্রায়তন পর্যায়ের (Micro-level) গবেষণা কার্যে এখনোগ্রাফিক অনুসন্ধান ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
৬. সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কর্ম প্রক্রিয়ায় যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানে তা গভীরভাবে অনুধাবন এবং অনুসন্ধান করে থাকে।
এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানের সুবিধা : নিম্নে এ সুবিধাগুলো আলোচনা করা হলো :
প্রথমত, এ গবেষণার বড় সুবিধা হলো গবেষককে গবেষণা এলাকায় অবস্থান করতে হয় এবং সরজমিনে ঘটনা তদারকি করে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যায় ।
দ্বিতীয়ত, এ পদ্ধতিতে গবেষককে কোন এলাকায় অনেকদিন অবস্থান করতে হয় বলে সেখানকার লোকদের সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক (Rapport) গড়ে তুলতে হয় এবং এ সম্পর্কের ভিত্তিতে উত্তর দাতাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য বের করে নিয়ে আসতে পারেন ।
তৃতীয়ত, এ পদ্ধতিতে গবেষককে পর্যবেক্ষক হিসেবে ঘটনার সময় উপস্থিত থাকতে হয় যা সঠিক ফলাফলের জন্য খুবই কার্যকর ।
চতুর্থত, এ পদ্ধতির মাধ্যমে কোন দল বা জনগোষ্ঠীরা সমাজকাঠামো, তাদের আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, রীতি- নীতি, বিশ্বাস ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে অবগত হওয়া যায় ।
পঞ্চমত, এ পদ্ধতিতে গবেষক নিরপেক্ষভাবে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন বিধায় প্রাপ্ত তথ্যের সঠিকতা ও যথার্থতা বৃদ্ধির সুযোগ বিদ্যমান থাকে।
ষষ্ঠত, এ পদ্ধতিতে গবেষককে বিষয়বস্তুর আঙ্গিকে গবেষণা এলাকায় উপাত্ত সংগ্রহ করেন বিধায় তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
সপ্তমত, এ পদ্ধতিতে গবেষককে গবেষণাধীন এলাকায় দীর্ঘকাল অবস্থান করতে হয় বলে কোন তথ্যই বাদ পড়ার সম্ভাবনা থাকে না।
অষ্টমত, এ পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্র মৌলিক ও নিরপেক্ষ। কেননা এতে কাঠামোগত প্রশ্নমালার নিয়ন্ত্রণ পক্ষপাতিত্ব ও সাক্ষাৎকার বিষয়ক জটিল পরিবেশের ঝামেলা পোহাতে হয় না ।
নবমত, এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে উত্তরদাতার ‘বলা বা না বলা’ উভয় ধরনের ভাবানুভূতির প্রকাশকে পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করা যায় ।
এথনোগ্রাফিক অনুসন্ধানের অসুবিধা : নিম্নে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
প্রথমত, এ অনুসন্ধানের প্রধান অসুবিধা হলো এতে প্রচুর সময় ব্যয় হয় এবং এটি খুব কষ্টসাধ্য। অনেক সময় বছরের পর বছর তাকে গবেষণাধীন এলাকায় থাকতে হয় এবং অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। ফলে গবেষণায় সঠিক ব্যাহত হয়।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু গবেষককে দীর্ঘকালব্যাপী গবেষণাধীন এলাকায় অবস্থান করতে হয়, সেহেতু গবেষককে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় । অর্থাৎ এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল অনুসন্ধান।
তৃতীয়ত, এ অনুসন্ধানে গবেষককে বিভিন্ন সমাজের মানুষের সাথে মিশতে হয় বলে অনেক সময় সামাজিক জটিলতা দেখা দেয়, যা উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
চতুর্থত, এ অনুসন্ধানে গবেষকের নিরপেক্ষতা অনেক সময় ক্ষুণ্ন হয়। কেননা গবেষক যে ব্যক্তি বা দল নিয়ে গবেষণা করেন তাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হলে তিনি পক্ষপাতদোষে দুষ্ট হবেন এবং সঠিক উপাত্ত সংগ্রহ করা তখন দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়ে।
পঞ্চমত, তথ্যাবলির নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করার জন্য এ অনুসন্ধান দ্বারা গবেষণার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একথা বলা যায় যে, সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে এখনোগ্রাফির অনুসন্ধান কার্যকরী ও যুগোপযোগী। এর মাধ্যমে উপজাতীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন করে জাতীয় সংস্কৃতির বৃহত্তম অঙ্গনকে আরো পুরিপুষ্ট, সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যমণ্ডিত করে তুলতে সক্ষম সম্ভব।