হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধে বাস্তবতার যে চিত্র এঁকেছেন তার পরিচয় দাও।

উত্তর : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন নিষ্ঠাবান গবেষক ও অন্যতম প্রবন্ধকার রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাঁর আসল নাম শরত্নাথ ভট্টাচার্য। বাংলা ভাষার প্রাচীন রচনার আবিষ্কর্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি সর্বাধিক। কেবল প্রাচীন পুঁথির আবিক্রিয়া বা বিস্তৃতপ্রায় মূল্যবান গ্রন্থসমূহের সম্পাদনাই হরপ্রসাদের একমাত্র কর্মকৃতি নয়, বিভিন্ন বিষয়ক মৌলিক প্রবন্ধ-রচয়িতা হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি উল্লেখযোগ্য আসনের অধিকারী হয়েছেন। ন্যায়ধর্মী বিচার-বিশ্লেষণ তাঁর রচিত প্রবন্ধের একটি বিশেষ গুণ। ভারতবর্ষীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি এ অঞ্চলের মানুষের প্রবৃত্তি এবং আন্তর্জাতিক চিন্তা-ভাবনা তাঁর প্রবন্ধকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রবন্ধসমূহ বিষয়গৌরবে ও স্বকীয় রচনাশৈলীগুণে মনোজ্ঞ ও চিত্তাকর্ষক হয়েছে। এ জাতীয় প্রবন্ধের মধ্যে তৈল’ প্রবন্ধটি অন্যতম। এ প্রবন্ধে তাঁর আলোচনা পদ্ধতির অভিনবত্ব এবং যুক্তিধর্মিতার চমৎকারিত্ব ও পারম্পর্য, সুবিন্যস্তভাবে পরিবেশনা প্রবন্ধটিকে বিশিষ্ট মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিকের সুচিস্তিত সিদ্ধান্তমুখী মানসিকতা, রচনার মধ্যে বিশুদ্ধ কৌতুক রসের পরিবেশনা প্রবন্ধটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে।
সমাজ-চিন্তার বিষয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রগতিশীল ভাব-ধারাকেই সমর্থন করেছেন এবং ক্ষেত্র বিশেষ তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিমচন্দ্র অপেক্ষাও বেশি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তৈল’ প্রবন্ধটিতে প্রাবন্ধিক মনুষ্য সমাজ, তার প্রকৃতি এবং জীবনাচরণের বিভিন্ন রূপ কৌতুকের বাতাবরণে এবং যুক্তিধর্মিতার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। প্রবন্ধের শুরুতে তিনি সংস্কৃত পণ্ডিতদের চিত্তা-ভাবনাকে আশ্রয় করে প্রবন্ধের সূচনা করেছেন। তেলে বিশেষ গুণ যে স্নেহ তা প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বক্তব্যে নিয়ে এসেছেন। যেমন- “সংস্কৃত কবিদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমার স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়ে থাকি।” প্রাবন্ধিক তৈলের যে শক্তি তা তিনি বিভিন্ন ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সেই পর্যবেক্ষণযাত অভিজ্ঞতাকে এখানে তুলে এনেছেন। প্রাবন্ধিক দেখেছেন তৈলের সর্বশক্তিমত্তার প্রকাশ। যেখানে সবকিছু ব্যর্থ- সেখানে তৈল কীভাবে কাজ করে সফল হয়। প্রাবন্ধিকের ভাষায় : “বাস্তবিক তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে।” হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তৈলের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগের বশবর্তী হলেও কখনো বাস্তব থেকে সরে যাননি। তিনি তাই তৈলের আরো গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন : “তৈলের মহিমা অপরূপ। তৈল নহিলে জগতের কোন কার্য সিদ্ধ হয় না। তৈল নহিলে কল চলে না, প্রদীপ জ্বলে না, ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহারা খোলে না, হাজার গুণ থাকুক তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না, তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না।” তবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর শুধু তৈলের ব্যবহার সম্পর্কে বলেই শেষ করেননি। তৈল কখন কীভাবে, কাকে মারতে হয় এবং তার গুণাগুণ কীভাবে প্রকাশ পায় সে সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। যেমন- “তৈল দিবার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি সকলেরই আছে এবং সুবিধামত আপন গৃহে ও আপন দলে সকলেই ইহা প্রয়োগ করিয়া থাকে। কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না।” বিদ্যা-বুদ্ধি-সম্পত্তিকে তৈল কীভাবে আরো মূল্যবান করে তোলে তা প্রাবন্ধিক আমাদের সামনে তার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেছেন- যা তৈলের গুণাগুণই প্রকাশ পায়। যেমন- “যাহার বিদ্যা আছে, তাহার তৈল আমার তৈল হইতে মূল্যবান। বিদ্যার উপর যাহার বুদ্ধি আছে, তাহার আর মূল্যবান। তাহার উপর যদি ধন থাকে, তবে তাহার প্রতি বিন্দুর মূল্য লক্ষ টাকা। কিন্তু তৈল না থাকিলে তাহার বুদ্ধি থাকুক, হাজার বিদ্যা থাকুক, হাজার ধন থাকুক, কেহই টের পায় না।” তৈলকে আমরা যে আমরা কতভাবে, কতকাজে ব্যবহার করি তা প্রাবন্ধিকের সরস ব্যঙ্গের মাধ্যমে চিত্রিত। হয়তো বাহ্য দৃষ্টিতে তা আমাদের সামনে ধরা পড়ে না। কিন্তু বাস্তবিক লেখকের যুক্তিগুলোকে আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। যেমন- “তৈলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম ভক্তি; যাহাতে গৃহিণীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম প্রণয়; যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম মৈত্রী; যাহা দ্বারা সমস্ত জগৎকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম শিষ্টাচার ও সৌজন্য,’ফিলিনথপি’।” এভাবেই প্রাবন্ধিক তাঁর ‘তৈল’ প্রবন্ধটিকে এগিয়ে নিয়েছেন এবং প্রবন্ধের পরিণতিতে তাঁর স্বাভাবিক যুক্তিপূর্ণ বাক্য, সরস কৌতুকরস সৃষ্টির প্রবণতা এবং সর্বোপরি মানব প্রকৃতি এবং সমাজের সারসত্য আবিষ্কার করেছেন তৈলের গুণাগুণ বিচারে। যেমন- “শেষে মনে রাখা উচিত, এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।” সুতরাং বলা যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কৌতুক রসের আবরণে ‘তৈল’ প্রবন্ধে তৈলের বিভিন্ন গুণের কথা বর্ণনা করেছেন। প্রাবন্ধিকের যুক্তিতে হাস্যরস থাকলে তা বাস্তব বিবর্জিত হয় না- আর এ কারণেই আমরা তৈলের বহুবিধ ব্যবহার সম্পর্কে পাঠক একটা স্পষ্ট ধারণায় উপনীত হতে পারে। তাই, বাস্তবে নিখঁতু চিত্র হিসেবে ‘তৈল’ প্রবন্ধের মূল্য অপরিসীম।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%88%e0%a6%b2-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%b9%e0%a6%b0%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%a6-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b8/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*