সুফিবাদের মূলনীতিগুলো আলোচনা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, সুফিবাদের মূলনীতিগুলো কী কী? আলোচনা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, সুফিবাদের মূলনীতি কী কী? সুফিবাদের মূলনীতিগুলো মূল্যায়ন কর।
উত্তর।। ভূমিকা :
সুফিবাদ হচ্ছে এক ধরনের মরমি ভাবধারা। সর্বকালের সর্বস্থানে প্রতিটি সমাজে কিছুসংখ্যক লোকের মধ্যে এ ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। এ ভাবধারা সেসব লোক কর্তৃক অনুসৃত হয়েছিল, যারা ছিল আল্লাহর ক্রোধের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত, অন্যদিকে তারা আল্লাহর করুণা বা তার দিদার লাভের প্রত্যাশী। ইসলামের ইতিহাসে যারা অতিপ্রাকৃত উপায়ে পরম সত্তা বা আল্লাহর সাথে একাত্মতা অর্জনে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তারা সুফি নামে পরিচিত। সুফিবাদ ইসলামের মতোই প্রাচীন এবং ইসলামের অবিভাজ্য অংশ।
সুফিবাদ : সুফিবাদ হচ্ছে মানব মনের একটি ধারণা। প্রতিটি সমাজে কিছুসংখ্যক লোকের মাঝে সুফি ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। সুফিবাদ এক প্রকার জীবনদর্শন। সুফিদের ধারণা, জগৎ প্রকৃতই এক মন্দ বাসস্থান যা মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি বা বিকাশের অন্তরায়। তাঁরা এ জগতের সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং তাঁদের দ্বারা কৃত পাপসমূহের জন্য অতীতকে অনুশোচনার সাথে স্মরণ করেন। আধ্যাত্মিক উন্নতিই তাঁদের লক্ষ্য। সুফিরা মনে করেন কেবল
বৌদ্ধিক আলোচনা দ্বারা এটা লাভ করা সম্ভব নয়। যদিও জ্ঞান সম্প্রসারণের জন্য আলোচনা অপরিহার্য তবুও একজন সুফি
সাধক যার গভীর অনুধ্যানে প্রজ্জ্বলিত তিনি একে ততটা গুরুত্ব দেন না। তিনি গভীর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আধ্যাত্মিক জ্যোতি লাভ করেন। এ জ্যোতির সাহায্যে তিনি সত্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অবলোকন করেন।
সুফিবাদের মূলনীতি : সুফিরা সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে আল্লাহর সিংহাসন ভেবে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে একাকার করে ফেলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য মানব আত্মার সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক বিকাশ সাধন এবং নিজ ক্ষুদ্র সত্তার বিলোপ ঘটিয়ে পরম সত্তায় একাত্মতা স্থাপন। সুফিগণ এ উদ্দেশ্যে কিছু মূলনীতির কথা বলেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. তওবা (অনুতাপ) : পাপের জন্য লজ্জিত হয়ে পুনরায় তা না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়াকে তওবা বলে। মূলত তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করা হয়, “তোমরা অনুতপ্ত হৃদয়ে তোমাদের স্রষ্টার পানে ফিরে যাও” (সূরা বাকারাহ; আয়াত ৫৪); “নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন”(সূরা বাকারাহ : আয়াত ২২৪); তখন আল্লাহ তার [হযরত আদম (আ)] প্রতি ক্ষমাপরবশ হয়ে মার্জনা করলেন (সূরা বাকারাহ : আয়াত ৩৭)।
২. তাওয়াক্কুল বা নির্ভরশীলতা : সর্ব অবস্থায় আল্লাহর উপর নির্ভর করে থাকার নাম তাওয়াক্কুল । ইসলামি তৌহিদ ধারণা থেকে তাওয়াক্কুল আগত। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তাঁর উপরই পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। সুফিবাদের বিশ্বাস, উচ্চতম স্তর থেকে মানুষের আগমন, কিন্তু সে তার আদি মর্যাদা থেকে বিচ্যুতি হয়েছে। পূর্ণ ও পূর্ণার সে মাত্রা পুনঃঅর্জন করতে হলে তাঁকে আত্মার নি ও হীনতার বৃত্তির সাথে কঠোর সংগ্রাম করতে হবে।
৩. পরিবর্জন : পরিত্রাণ লাভের জন্য সুফিগণের ন্যূনতম পার্থিব বিষয় থাকা বাঞ্ছনীয়। অভাব ও দারিদ্র্য সম্পর্কে সুফিদের ধারণা প্রকৃত সম্পদের অভাবের চেয়ে সম্পদ অভাবের ইচ্ছার অনুপস্থিতিকে অর্থ করে। শূন্য হৃদয়, শূন্য হাত এ হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। সত্যিকার দরিদ্র লোকের একটাই ইচ্ছা, সেটা হচ্ছে আল্লাহ প্রেম ও ধ্যান। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সুফিরা পার্থিব জগতের সুখভোগ ও বিলাসিতা বর্জন করেন।
৪. সবর বা ধৈর্ম : সবর বলতে বুঝায় প্রসন্ন বদনে দুঃখ যন্ত্রণা বরণ করা, অবৈধ কাজ হতে বিরত থাকা, অদৃষ্টের আঘাত নীরবে সহ্য করা, দারিদ্র্যের মাঝে নিজেকে মানসিকভাবে দৃঢ় রাখা, নিরবে নির্দ্বিধায় বিপদ মেনে নেয়া, আল্লাহর প্রতি আস্থার দৃঢ়তা এবং আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত বিপদ হাসিমুখে পরম ধৈর্যের সাথে পরিগ্রহণ করাকে অর্থ করে। সবর দুই প্রকার। যথা : ১. দৈহিক ও ২. আত্মিক। দৈহিক সবর যেমন- শারীরিক পীড়া সহ্য করা। আর আত্মিক সবর হলো প্রবৃত্তির তাড়নাকে সংযত করা।
৫. আনুগত্য : আধ্যাত্মিক যাত্রাপথে সুফি সাধক একজন পথনির্দেশক বা পীর বা মুর্শিদের শরণাপন্ন হতে তাগিদ দেন। তিনি পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে এমন এক সম্পর্ক স্থাপিত হয় যে, শিষ্য পীরের কাছে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেন এবং আনুগত্যে চরম নিষ্ঠা প্রদর্শন করে থাকেন।
৬. এখলাস : এখলাস শব্দের অর্থ পরিষ্কার, খাঁটি ও নির্মল রাখা, সংমিশ্রণ হতে মুক্ত রাখা। পবিত্র কুরআনে ১১২তম সূরা আল্লাহর একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বের উপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং তার কোন সমকক্ষের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। এ অর্থে এখলাস শিরকের বিপরীত। এটি একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা এবং আদর্শ ও ধারণাকে যাবতীয় আনুষঙ্গিক চিন্তা হতে মুক্ত রাখা বুঝায় ।
৭. ইশকে খোদা : সুফিবাদ হলো প্রেমের দর্শন। সুফি হৃদয় সবসময়ই আল্লাহর চিন্তা ও ধ্যানে মগ্ন থাকে। আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের জন্য তারা সর্বদা উন্মুখ থাকেন। জাগতিক কোন বিষয়ই তাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। এ দিক দিয়ে সুফিবাদকে প্রেম ধর্ম বা প্রেম দর্শন নামেও অভিহিত করা হয়।
৮. জিকির : জিকির যখন মনে হয় (বি আল কালব) তখন তার অর্থ স্মরণ করা। যখন জিহ্বা দ্বারা হয় (বি আল লিসান) তখন তার অর্থ উল্লেখ্য করা, বর্ণনা করা। জিকির শব্দটি যখন সুফিদের পারিভাষিক শব্দরূপে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ ভিন্ন। শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও বিশেষ ধরনের নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চস্বরে অথবা মনে মনে ধর্মীয় বাণী সংযোগে বার বার আল্লাহতায়ালার মহিমা প্রকাশসূচক শব্দ উচ্চারণ করার নাম জিকির।
৯. কাশফ : কাশফ শব্দের অর্থ উন্মোচন করা। সুফি সাধক ও তাসাওউফ পন্থিগণ শব্দটিকে আধ্যাত্মিক রহস্য উন্মোচন করার অর্থে ব্যবহার করেন। সূক্ষ্ম বিচারে একে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ক. আকল বা যুক্তিলব্ধ জ্ঞান, খ, ইলম বা শিক্ষালব্ধ জ্ঞান ও গ. মুশাহাদা বা প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার (মা’রিফা) মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান।
১০. শোকর : সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা সুফি সাধনার আরেক বৈশিষ্ট্য। এ পৃথিবী ও পৃথিবীর বাইরে যা কিছু আছে আল্লাহই হচ্ছেন তার সব কিছুর মালিক। তিনি সর্বক্ষমতাবান, তার ইচ্ছামাফিক সবকিছু ঘটছে। যা কিছু ঘটছে তা মানুষের কল্যাণ বা মঙ্গলের জন্যই হচ্ছে।
১১. সামা বা সংগীত : কোন কোন সুফি সাধক সংগীতে অনুরাগী। তাদের ধারণা, সংগীতের সুর ও মূর্ছনা অন্তরের সুপ্ত আধ্যাত্মিক অনুভূতিকে সক্রিয় করে তুলতে পারে এবং মনকে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন করতে সহায়তা দান করতে পারে। চিশতিয়া তারিকার সুফিরা তাম্বুরা ব্যবহার করে সামবা সংগীত গেয়ে আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলেন।
১২. ফানা ও বাকা : সুফি সাধনার সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে ফানা ও বাকা। ফানা অর্থ বিলুপ্তপ্রাপ্তি বা ধ্বংসপ্রাপ্তি। মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছাতে বিলুপ্তকরণের অর্থ হচ্ছে ফানা। সুফি সাধক সব সৃষ্টবস্তু হতে দৃষ্টি পরিহার করে কেবল আল্লাহর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন। আত্ম বিলোপের মাধ্যমে আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করে সুফি সাধক অনন্তজীবনের পূর্ণতা প্রাপ্তির পথে। অগ্রসর হন। সুফিগণ মনে করেন আমিত্ববোধ যতগুলো সিফাতের সমন্বয়ে গঠিত সেগুলো বিলোপ সাধন করাই হলো ফানা। ফানা শব্দটি বাঁকা অর্থাৎ, স্থিতি বা নিত্যতা শব্দের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। স্বকীয় ইচ্ছার বিলোপ সাধন করে আল্লাহতে অবস্থান করার নাম হলো বাকা। বাকা স্তরে সুফি তন্ময়তার মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিগত চেতনা অবলুপ্তি করে ঐশী
চেতনায় উন্নীত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুফিবাদের বীজ ইসলামের প্রারম্ভেই সূচিত হয়েছিল। হুজুরে পাক (স) প্রায়শই ধ্যানমগ্ন থাকতেন। সাহাবাগণ একনিষ্ঠভাবে তাকে অনুসরণ করে গেছেন। তাদের মধ্যে একদল ঘনিষ্ঠ সাহাবা বিশ্বাস গ্রহণের মুহূর্ত হতে ছিলেন মরমি ভাবাপন্ন। পার্থিব বিষয়ে তারা উদাসীন এবং কদাচিৎ তারা জাগতিক বিষয়ে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতেন। তাঁরাই আহলে উস সুফফা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পরবর্তীতে আব্বাসীয় শাসনামলে কিছু সুফিদের মধ্যে শরিয়ত উপেক্ষার প্রবণতা দেখা দেয়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*