সংসদীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ আলোচনা কর।

অথবা, সংসদীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না? মতামত দাও।
অথবা, সংসদীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় গণতন্ত্র হচ্ছে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী বহু আকাঙ্ক্ষিত শব্দ যা আধুনিক যুগের জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা। এ গণতান্ত্রিক সরকারকে আইন বিভাগের সাথে শাসন বিভাগের সম্পর্কের ভিত্তিতে দুইভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার এবং অপরটি হচ্ছে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। তাছাড়া, সংসদীয় শাসনব্যবস্থার কল্যাণকামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ দেশের মানুষের মৌলিক সাম্য ও স্বাধীনতার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ব্যাপক অর্থে সংসদীয় সরকারের উপর্যুক্ত সংজ্ঞা প্রদান করা হলেও বর্তমানে এরূপ শাসনব্যবস্থায় সংসদের প্রাধান্যের পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করে থাকেন। গ্রেট ব্রিটেন, ভারত, কানাডাসহ প্রভৃতি দেশে এ শাসনব্যবস্থা প্রচলিত আছে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি : ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে এক অধ্যাদেশ বলে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু মাত্র তিন বছর পর আবার সংসদীয় পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় প্রবেশ করেন। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর দেশে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কৃষ্টির সাথে সংসদীয় ব্যবস্থা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ভৌগোলিক অবস্থান : ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সুবিধাজনক । অধুনা ৫টি বিভাগ নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের কোনো অংশেই বিচ্ছিন্নতাবাদ নেই। জনগণের ভাষা, জীবন প্রণালি, পোশাক পরিচ্ছন আচার আচরণ প্রায় এক ও অভিন্ন। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয় আদর্শে সকলেই উদ্বুদ্ধ। জাতীয় ঐক্যে সকলেই সুসংহত। সুতরাং, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে সর্বাধিক উপযোগী। দলের উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি।
২. শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের অভাব : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে সফল করতে হলে শক্তিশালী রাজনৈত্রি লক্ষণীয়। এ অবস্থায় সংসদীয় ব্যবস্থা চলতে পারে না। তবে বর্তমানে যে সংসদীয় ব্যবস্থার সূচনা হয়েছে ভবিষ্যতে তারে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হলে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের দরকার, যা বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
৩. আইন ও শাসন পরিষদের গভীর সম্পর্ক : সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতা ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। ফলে এরূপ শাসনব্যবস্থা সুশাসনে পরিণত হয় এবং আইন শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সেতু রচিত হয়। কিন্তু অন্যান্য শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে না।
৪. গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব : সংসদীয় ব্যবস্থাকে সফল করতে হলে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন বিদ্যমান থাকায় গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব হয় নি, যা বর্তমানে সংসদীয় ব্যবস্থায় নীতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৫. জনমতের মূল্যায়ন : সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে জনগণের সার্বভৌমত্ব সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাধান্য লাভ করে। এবং শাসনব্যবস্থায় সরকারকে জনগণের মতামতের মূল্য দিতে হয় এবং তার কার্যাবলির জন্য জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয়। অপরদিকে, অন্যান্য শাসনব্যবস্থায় জনমত উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ অন্যান্য পদ্ধতির সরকার বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে ও নিজের ইচ্ছামতো শাসনকার্য পরিচালনা করে বলে জনমতের মূল্যায়ন ঘটে না।
৬. সরকারের জবাবদিহিতা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা বলা হয়। এ সরকার ব্যবস্থায় সরবর তার কাজের জন্য সংসদের নিকট দায়িত্বশীল থাকে। এ সরকারের প্রতিটি কাজের জন্য সংসদের নিকট জবাবদিহিতা করতে হয় ফলে এ শাসনব্যবস্থায় সহজে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে না। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার এ স্পষ্টতা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য এট সফলতা অর্জন করে। এ দিক থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য উপযোগী।
৭. ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব : ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার অনুপযোগ অথচ বাংলাদেশে এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্যমান। বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তনের পরই সরকারের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বৃদ্ধি পাওয়ায় সংসদীয় ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
৮. রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার অন্যান্য পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থাকে বেশি পরিমাণে প্রভাবিত করে তোলে। তাছাড়া এরূপ সরকার ব্যবস্থায় একাধিক বিরোধী দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে এবং বিরোধী দল ও সরকার দলের মাধ্যমে যেসব আলোচনা হয় তা প্রচার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচার করা সম্ভব হয়। ফলে জনগণ অধিকতর রাজনৈতিক সচেতন হয়ে ওঠে, যা অন্যান্য পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় থাকে না ।
৯. জনগণের সার্বভৌমত্ব : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্ব সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত । এ ব্যবস্থায় সরকার তা কার্যাবলির জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহিতা করে বাধ্য। সরকারকে নিয়মিত জনগণের পরীক্ষানিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
১০. শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব : সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে ছায়া সরকার বলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতা লাভের আশায় সংসদকে বাদ দিয়ে রাজপথে আন্দোলন শুরু করে, যা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে সফল করতে বাধা দেয়। হয়। কেননা, রাজাকে নিয়মতান্ত্রিক প্রধান রেখে মন্ত্রিপরিষদে প্রধানমন্ত্রীকে প্রকৃত শাসক হিসেবে দেশের শাসনকার্যাদি
১১. গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের সমন্বয়সাধন : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমন্বয়সাধন করা সম্ভব পরিচালনা করতে হয়। ফলে সরকার ব্যবস্থায় রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় ঘটে। প্রভাবে দরিদ্রদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে না। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার
১২. অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান : অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সমাজে ধনীদরিদ্রের ব্যবধান সৃষ্টি হয়। ধনীদ্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। এতে সাধারণ জনগণ স্বাধীনভাবে রাজনীতিতে অন্য সরকার ব্যবস্থায় তা নেই।
ব্যবস্থায় দক্ষ প্রশাসনের অভাব বিধায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে প্রশাসনের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
১৩. প্রশাসনিক শূন্যতা : সংসীয় সরকারকে সফল করতে হলে দক্ষ প্রশাসন প্রয়োজন।
১৪. ক্ষমতাসীন দলের প্রাধান্য : সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের একক প্রধান্য এ ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলে। বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের একক প্রাধান্য রাখার জন্য সংবিধানে নিয়ম করা হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে সংসদীয় ব্যবস্থা সফল হতে পারে না।
১৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা : সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি দল ও বিরোধী দল পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে শাসনকার্যের সিদ্ধান্ত স্থির করে বলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরপক্ষে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় অনেক সময় দুঃশাসন পরিলক্ষিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা একথা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেননা, সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কার্যকর করতে হলে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে। এ দেশে প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি বিদ্যমান। কেননা, সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য খুবই কম পরিলক্ষিত হয়। একদল আরেকদলের কার্যক্রমকে পছন্দ করে না। তাছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অনিয়মিত এবং নির্বাচনে কারচুপি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ইত্যাদি অনিয়ম ঘটে থাকে। যার ফলে নিরপেক্ষ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে না। সূরাং একথা বলা যায় যে, আধুনিক বিশ্বে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা হলেও বাংলাদেশের রাজনেতিক সংস্কৃতির সাথে এর সামঞ্জস্যতা খুবই কম।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a6%a6%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%ac%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*