শিল্পায়ন কী? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পের গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, শিল্পায়ন কাকে বলে? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
অথবা, শিল্পায়ন কী? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পখাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নিম্ন আয়স্তরের এদেশে উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনীতির ক্রমরূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে শিল্পোন্নয়ন অপরিহার্য। শিল্প দেশের মানুষের জন্য ভোগ্য ও পুঁজি দ্রব্য এবং কৃষির বিভিন্ন উপকরণ সারবারহ করে এবং কৃষিজ দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত করে। বস্তুত আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একান্তভাবে শিল্পনির্ভর । বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের বিশেষ এক আশীর্বাদ হচ্ছে শিল্পায়ন। শিল্প তথা শিল্পায়নের বিস্তৃতি ছাড় কোন সভ্য জাতির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আর শিল্পায়ন তখনই একটি দেশের জন্য আশীর্বাদ হবে, যখন শিল্পায়নের সুষ্ঠু বিকাশে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেসব প্রতিবন্ধকতাসমূহকে দূর করা যাবে।
শিল্পায়ন (Industrialization) : শিল্পায়ন পদটি দ্বারা মূলত কৃষি সমাজ থেকে যান্ত্রিক শিল্পের বিকাশকে বুঝানো হয়ে থাকে। শিল্পায়ন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Industrialization’। যা ল্যাটিন শব্দ Industria হতে উৎপন্ন হয়েছে। আর Industria শব্দের অর্থ হলো কর্মকাণ্ড বা উদ্যোগ। বিস্তৃত অর্থে শিল্পায়ন বলতে কোনো খাতে বৃহৎ যান্ত্রিক উৎপাদন সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বুঝানো হয়ে থাকে। সীমিত অর্থে শিল্পায়ন বলতে শিল্পায়ন দ্বারা কেবলমাত্র প্রস্তুতকরণ শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশকে বুঝানো হয়ে থাকে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে শিল্পায়নকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। মধ্যে কিছু সংজ্ঞা নিয়ে তুলে ধরা হলো : জাতিসংঘের শিল্পোন্নয়ন কমিটি প্রদত্ত শিল্পায়নের সংজ্ঞায় বলা হয় যে, “শিল্পায়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের এমন এক প্রণালি, যাতে জাতীয় সম্পদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ অভ্যন্তরীণ, আর্থিক ও বৈচিত্র্যময়।” (Industrialization is a process of economic development in which a growing part of national resources is mobilized to develop a technically uptodate, diversified, domestic, economic, structure.)
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আলী আকবর খান তাঁর ‘Elements of Social Work’ গ্রন্থে শিল্পায়নকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, “শিল্পায়ন শুধু জনগণের পেশাগত কাঠামোরই আমূল পরিবর্তন ঘটায় না, এমনকি এটা অর্থনৈতিক কার্যাবলির স্থানান্তরও ঘটিয়ে থাকে।” (Industrialization is not only radically changes the occupation structure of the people but also shifts the location of the economic activities.) রাশিয়ার সমাজবিজ্ঞানী ভি. তিয়াগুণেনকো এবং কোলনতাই (V. Tyagunenko and Kollontai) তাঁদের ‘Problems of Industrialization is Development Countries’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, “শিল্পায়ন বলতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কেবলমাত্র একটি দিককে বুঝায়।” আইভান ফস্টার কার্টার (Ivan Faster Curter) এর মতে, “শিল্প বলতে বুঝায় শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন আর বৃহৎ অর্থে শিল্প হচ্ছে শিল্পায়নের বৃহত্তর সামাজিক প্রক্রিয়া বিশেষ।” হেনরি. পি. ফেয়ারচাইল্ড (Henry P. Fairchild) তাঁর ‘Dictionary of Sociology and Related Science |
গ্রন্থে বলেছেন, “শিল্পায়ন হচ্ছে একটি প্রত্যয়, যা মূলত উৎপাদনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটি সমাজে ভূমি ব্যবস্থার বদলে আধুনিক শিল্প স্থাপন, যার প্রেক্ষিতে উদ্ভব ঘটে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কিছু সমস্যা।” (Industrialization is a term | of covering in general terms the Growth in a society hithers mainly Agrarian of modern Industry, with its attendants circumstances and problems, economic and social.)
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, শিল্পায়ন হচ্ছে কৃষিজ দ্রব্যের রূপান্তর ঘটিয়ে অন্য জাতের পণ্য উৎপাদনে এবং অকৃষিজ পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যন্ত্র চালিত উৎপাদন ব্যবস্থার প্রবর্তন। যেমন- বলা যায় কৃষিজ দ্রব্য পাটকে রূপান্তর করে কার্পেট-চট-থলে এবং তুলাকে রূপান্তর করে কাপড় তৈরি করতে যথাক্রমে পাট শিল্প এবং বস্ত্র শিল্পের প্রবর্তন। আবার বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে সার শিল্প স্থাপন করা যায়। শিল্পায়ন তাই এমন একটি প্রক্রিয়ার নাম যে প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে অকৃষিজ পণ্য উৎপাদিত হয়। আমরা আরো বলতে চাই যে, শিল্পায়ন এমন একটি প্রক্রিয়াবিশেষ যার উপর ভিত্তি করে অনগ্রসর সমাজগুলো আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে রূপান্তরিত হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পের গুরুত্ব (Importance of industry in the economy of bangladesh) : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পের গুরুত্ব নিম্ন লিখিত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হলো :
১. জাতীয় আয় বৃদ্ধি : বাংলাদেশে জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় অনেক কম। জাতীয় আয় বৃদ্ধির জন্য শুধুই উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটলে আমাদের জাতীয় ও মাথাপিছু আয় বাড়বে। ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হবে।
২. কৃষি উন্নয়ন : বাংলাদেশের কৃষির উন্নতি ও আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজন আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি। যান্ত্রিক চাষ ও সেচ যন্ত্র, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রভৃতি উপকরণের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য শিল্পায়ন আবশ্যক। তাছাড়া শিল্প বিভিন্ন দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৩. প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রচুর পাট, বনজ সম্পদ, চা, চামড়া, ইক্ষু, গ্যাস ও চুনাপাথর প্রভৃতি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব। তাহলে দেশে বিভিন্ন প্রকার বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠবে এবং জাতীয় আয় ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে।
৪. কৃষির উপর জনসংখ্যার চাপ হ্রাস : বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে জনসংখ্যার চাপ বেশি হওয়ায় জমির খণ্ড-বিখণ্ডতা এবং ছদ্ম বেকারত্ব বাড়ছে। শিল্পখাত সম্প্রসারিত ও উন্নত হলে কৃষির উদ্বৃত্ত জনশক্তি শিল্পক্ষেত্রে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে। এর ফলে কৃষিতে মাথাপিছু উৎপাদন বাড়বে এবং ছদ্ম বেকারত্ব হ্রাস পাবে।
৫. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি : বাংলাদেশে শিল্পখাতের উন্নতি ও প্রসারের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনশক্তির জন্য কর্মসুযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাছাড়া শিল্পায়নের ফলে কৃষিক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি স্থানান্তরিত হবে এবং কৃষির ছদ্ম বেকারত্ব হ্রাস পাবে।
৬. রপ্তানি বৃদ্ধি ও আমদানি হ্রাস : শিল্পোন্নয়নের মধ্যমে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি এবং আমদানি হ্রাস পাবে। এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি হ্রাস পাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়বে। উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ৮৮ ভাগ শিল্পখাত থেকে আসে।
৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : বিশ্বের সব উন্নত ও ধনী দেশ শিল্পোন্নত। বাংলাদেশে কার্যকর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষিখাত এককভাবে সম্ভব নয়। শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে দেশে আয়, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি সম্ভব। তাছাড়া কৃষি অপেক্ষা শিল্প ও উৎপাদন দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায়। সুতরাং দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থেই এদেশে শিল্পোন্নয়ন আবশ্যক।
৮. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন : বাংলাদেশে কৃষির নিম্ন উৎপাদনশীলতার জন্য জনগণের আয় কম ও জীবনযাত্রার মান নিচু। শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে দেশে উৎপাদন, আয় ও ভোগ বাড়ে। ফলে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। সুতরাং দ্রুত শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের জনগণের জীবনযাত্রার মান লক্ষণীয়ভাবে বাড়ানো সম্ভব।
৯. পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পকারখানা স্থাপনের প্রয়োজনে সুষ্ঠু যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠে। আবার যানবাহন ও যোগাযোগের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও উপকরণের যোগান বৃদ্ধির জন্যও শিল্পের উন্নয়ন প্রয়োজন। তাই শিল্পখাতের উন্নতির মাধ্যমে উৎপাদন, আয়, কর্মসংস্থান তথা সার্বিক অর্থনৈতিক
স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
১০. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন : বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য উন্নত ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন। এসব উপকরণ তৈরির জন্য শিল্পকারখানা স্থাপন করা দরকার।
১১. পরনির্ভরতা হ্রাস : বাংলাদেশে বিভিন্ন ভোগ্য ও পুঁজি দ্রব্য এবং উন্নয়নের অন্যান্য উপকরণের জন্য বেশিমাত্রায় বহির্বিশ্বের উপর নির্ভশীল । উন্নত শিল্পখাতে আমদানি হ্রাসে ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করে বলে দেশে শিল্পোন্নয়ন ঘটলে আমাদের পরনির্ভশীলতা হ্রাস পাবে।
১২. নগরায়ণ ও সামাজিক উন্নয়ন : বাংলাদেশে বেশিসংখ্যক শিল্পকারখানা স্থাপিত হলে নগরায়ণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। তাছাড়া শিল্পায়নের ফলে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সেবার যোগান বৃদ্ধি পায় বলে সামাজিক উন্নয়নের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই বাংলাদেশে দ্রুত শিল্পোন্নয়ন হলে উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস, অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর, উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পের প্রসার ও উন্নয়ন অপরিহার্য। বস্তুত এদেশে দীর্ঘ সময়ের অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও দারিদ্র্যমোচনের জন্য শিল্পোন্নয়নের বিকল্প নেই।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*