রাষ্ট্র কী? রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ বর্ণনা কর।

অথবা, রাষ্ট্র বলতে কী বুঝ? রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদানসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রের উপাদানগুলো কী কী? আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্র কাকে বলে? কী কী উপাদান নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়? আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্র বলতে কী বুঝ? রাষ্ট্রের উপাদানগুলো আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা সমাজস্থ মানুষের সমগ্র জীবন প্রণালী পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা সকলেই রাষ্ট্রের সদস্য। রাষ্ট্র ছাড়া কোনো মানুষই বসবাস করতে পারে না। এজন্য এরিস্টটল বলেছেন, “মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব।” রাষ্ট্রের মধ্যে আমরা জন্মগ্রহণ করি,
লালিতপালিত হই এবং মৃত্যুবরণ করি। তাই মানবজীবনে রাষ্ট্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা : সাধারণত রাষ্ট্র বলতে আমরা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিষ্ঠিত এক আবশ্যিক সংগঠনকে বুঝে থাকি। ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ষোল শতকের বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলি। রাষ্ট্র শব্দটি অনেকক্ষেত্রে সরকার, সমাজ, জাতির সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বুন্টসলি এর মতে, “কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমাজই রাষ্ট্র।” অধ্যাপক হলো এর ভাষায়, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এমন জনসমাজই রাষ্ট্র।” অধ্যাপক ব্রিউস্টার এর মতে, “রাষ্ট্র এমন সংগঠিত জনসমষ্টি, যা কোনো সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারী এবং যার কোনো স্বাধীন বা সার্বভৌম সরকার আছে।” অধ্যাপক লাস্কি তাঁর ‘A Grammer of Politics’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, সমাজবিশেষ, যা সরকার ও জনগণের মধ্যে বিভক্ত এবং যা এর নিজস্ব ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের উপর সার্বভৌমত্ব দাবি করে।” রাষ্ট্রপতি উইলসন এর ভাষায়, “কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইন অনুসারে সংগঠিত কোনো জনসমষ্টিকে রাষ্ট্র বলে।” ওপেনহেইম এর মতে, “কোনো জনসমষ্টি এর নিজস্ব সার্বভৌম সরকারের অধীনে কোনো দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে তাকে রাষ্ট্র বলে।”
নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন অধ্যাপক গার্নার। তাঁর মতে, “রাষ্ট্র হলো ব্যাপক জনসম এবং যার একটি সংগঠিত সরকার আছে, যে সরকারের প্রতি অধিকাংশ নাগরিক স্বাভাবিকভাবে অনুগত থাকে।” উপর্যুক্ত সংজ্ঞাসমূহের আলোকে বলা যায় যে, রাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ একক ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যার জনসমষ্টি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সংগঠিত সরকার গঠন করে স্বাধীনভাবে বসবাস করে ।
রাষ্ট্রের উপাদান : উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেক রাষ্ট্রই চারটি উপদান নিয়ে গঠিত। যথা :
১. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড : রাষ্ট্র অপরিহার্যরূপে একটি ভৌগোলিক প্রতিষ্ঠান। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসীমা রাষ্ট্রকে একটি বলয়ে আবদ্ধ করেছে। রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এজন্য রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। রাষ্ট্রের জনগণকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে বসবাসের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সুবন্দোবস্ত করতে হয়। তবে রাষ্ট্রের সীমারেখা বা আয়তন কত হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা আইন নেই। আবার ভূখণ্ড বলতে শুধু মাটির উপরিভাগকে বুঝায় না, মাটির নিচের সম্পদ, মাটির উপরের নদী, পাহাড় পর্বত এমনকি সমুদ্রের উপকূলভাগকেও বুঝায়। সমুদ্রের জলাভূমি হতে বারো মাইল পর্যন্ত জলরাশি রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত বলে।
২. জনসমষ্টি : রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জনসমষ্টি। জনসমষ্টির ইচ্ছা প্রণোদিত পরস্পরের সাথে সম্বন্ধ হতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। কাজেই জনসমষ্টি ছাড়া রাষ্ট্রের ধারণা অসম্ভব। পশুদল কর্তৃক রাষ্ট্র গঠিত হয় না। আবার জনশূন্য দেশ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় না। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অবস্থান ও ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল রচিত হয়। তবে রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কত হবে তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কয়েক কোটি হতে
পারে, আবার কয়েক হাজারও হতে পারে। যেমন- বর্তমানে চীনের জনসংখ্যা প্রায় একশত ত্রিশ কোটি। আবার পৃথিবীর
ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র হচ্ছে ভ্যাটিকান, এর জনসংখ্যা সাতশত আটাত্তর জন।
৩. সরকার : রাষ্ট্র গঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে সরকার। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা, আদর্শ, উদ্দেশ্য, প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা এবং রাষ্ট্রে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা সরকারের গুরুদায়িত্ব। সরকার গঠিত হয় আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগের সমন্বয়ে। মোটকথা, রাষ্ট্র সরকার ছাড়া চলতে পারে না। ‘সরকার’ শব্দটি সংকীর্ণ অর্থে রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রিবৃন্দকে বুঝায়। কিন্তু ব্যাপক অর্থে এটা শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্গত সকলকে বুঝায়, যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে থাকে। অন্যকথায়, যারা আইন প্রণয়ন করছেন, আইন রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত রয়েছেন এবং ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদেরকে সমবেতভাবে সরকার নামে অভিহিত করা হয়। এ অর্থে গ্রাম্য চৌকিদার হতে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত সকলকে সমবেতভাবে আমরা সরকার বলতে পারি। বিচার বিবেচনা করেছেন। এরিস্টটল এর মতে, “গাছপালা বৃদ্ধির যেমন একটা পরিমাণ আছে, রাষ্ট্রের জনসমষ্টিরজীবনধারণ এবং মানবিক বিকাশের জন্য তেমন একটি সীমারেখা থাকা উচিত।” তবে একথাও সত্য যে, রাষ্ট্রের আদর্শ সামনে রেখে ভূখণ্ডের পরিসীমা নির্ধারণে আগ্রহী ছিলেন।
৪. সার্বভৌমত্ব : সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অধ্যাপক বার্জেস এর মতে, “ সার্বভৌমত্ব হচ্ছে প্রত্যেক প্রজার এবং প্রজাদের সকল প্রকার সংঘের উপর মৌলিক, চরম, অসীম ও সর্বাত্মক ক্ষমতা।” সার্বভৌমত্ব ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও স্বরূপ বহুলাংশে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃতি ও
অবস্থানের উপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিকই এ সার্বভৌম ক্ষমতার অধীন। সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বে কোনো আইনগত ক্ষমতা নেই এবং এর বিরুদ্ধে নালিশ করার মত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও নেই। সাধারণত রাষ্ট্রের কষ্টিপাথর বলে সার্বভৌমত্বকে আখ্যায়িত করা হয়। উৎকৃষ্ট স্বর্ণ যেমন কষ্টিপাথরে যাচাই করা হয়, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে যাচাই করতে হলে সার্বভৌম ক্ষমতার মানদণ্ডে একে পরীক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্লাক স্টোন বলেছেন, “সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের চরম, অপ্রতিরোধ্য, চূড়ান্ত ও সীমাহীন ক্ষমতা।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র মানুষের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি প্রতিষ্ঠান। সরকার রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। রাষ্ট্রকে এক বিমূর্ত ভাব এবং সরকারকে এর বাস্তব রূপ বলেও ধরা হয়। যেহেতু রাষ্ট্র হলো প্রকারভেদহীন; অপরদিকে বাস্তবরূপে সরকার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে সরকার ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। সরকার হলো জাহাজের চালকের ন্যায়। চালকবিহীন যেমন জাহাজ চলতে পারে না, তেমনি সরকার ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। মোটকথা, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি উপাদানই গুরুত্বপূর্ণ। মোটকথা, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি উপাদানই গুরুত্বপূর্ণ।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*