রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ আলোচনা কর।

অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদের বিবরণ দাও।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদী দর্শন ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
উত্তর।। ভূমিকা :
মানুষই তার পরিবেশ, প্রতিবেশ, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, নৈতিকতা সবকিছুর ” নিয়ন্ত্রক। তার সৃষ্টিকর্মে অপ্রকৃতির কোনো স্থান নেই। অলৌকিকতার সবটা তার প্রজাতির নিজস্ব এবং লোকায়ত, এটাই মানবতাবানের মূলকথা। গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসকে মানবতাবাদী দর্শনের জনক বলা হয়। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “মানুষই সবকিছুর মূল্যায়নের মাপকাঠি” (Man is the measure of all things)। আধুনিক যুগেও হবস, লক, রুশো প্রমুখ দার্শনিকও মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন। ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহম্মদ (স) মানবতার সপক্ষে ঘোষণা করেছিলেন, “মানুষ একই আদমের সন্তান, মানুষ পরস্পর সমান, মানুষ পরস্পর ভাই, সাদা কালো, ধনী দরিদ্রে কোনো ভেদাভেদ নাই।” চতুর্দশ থেকে ষষ্ঠদশ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁর মাধ্যমে পাশ্চাত্য মানবতাবাদের উন্মেষ ঘটে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ: আকাশের সাথে যেমন কোনোকিছুর তুলনা করা যায় না, তেমনি রবীন্দ্রনাথের সাথে কারও তুলনা করা যায় না। এ আকাশ তুল্য যোগ্যতার জন্য তিনি বিশ্ব কবি’ খেতাব লাভ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে যাঁদের কণ্ঠে মানবতার জয়গান শোনা যায়, তাঁদের মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রেম ও মৈত্রীর মহামিলনের পথে এক ভাবসমন্বয়ের মাঝে বিশ্বমানব চিত্রের শুভ উদ্বোধন করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১
সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, তথাপি গরিবদের দুঃখকষ্ট তাঁর মনকে নাড়া দিয়েছে সবসময়।
১. কাব্যে মানবতাবাদ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে মানবতার কবি ছিলেন তা তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে বিশদভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বিভিন্ন কাব্যে আমরা মানবতার জয়গান দেখতে পাই। তাঁর প্রথম দিকের কাব্যগুলোর মধ্যে চৈতালী (১৮৯৫) কাব্যের কবিতাগুলোতে তাঁর মানবতাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে, ‘পুনশ্চ’ কাব্যে কবির মানবতার সুর আরও সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এ কাব্যে সাধারণ মানুষের সহজ সরল জীবন ফুটে উঠেছে। সাঁওতাল মেয়ে, ক্যামেলিয়া,
অন্তঃপুরের সাধারণ মেয়ে, এরা কেউ কবির দৃষ্টির আড়ালে পড়েনি। তাঁর বিভিন্ন কবিতা ও গানে মানবতার সুর দেখা যায়। যেমন-
“যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার বাজে-
সবার পিছে, সবার নীচে
সর্বহারাদের মাঝে।” [গীতাঞ্জলি : কবিতা নং-১০৭)
২. ধর্মীয় মানবতাবাদ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি স্রষ্টার সাথে মানুষের প্রেমের কথা বলেছেন। তিনি ‘পুনশ্চ’ কাব্যে মানুষ ও স্রষ্টাকে পরস্পর নির্ভরশীল করে অঙ্কিত করতে চেষ্টা করেছেন। ‘বলাকা’ (১৯১৬) কাব্যের ৩১নং কবিতায় ধর্মীয় মানবতাবাদ ফুটে উঠেছে।
“তৃণদ
মাটির আকাশ পরে ঝাপটিছে ডানা;
মাটির আধার নিচে’ কে জানে ঠিকানা,
মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।” (বলাকা)
কৰি মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে চিত্রিত করার জন্যই অলংকার বা উপমা ব্যবহার করেছেন। ঈশ্বর যেমন জীবের মিলন পিয়াসী, জীবও তেমনি পরমাত্মার জন্য তৃষ্ণার্ত। তিনি স্রষ্টার সাথে প্রেমের চিত্র তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যে তুলে ধরেন। যেমন-
“পুষ্প যেমন আলোর লাগি
না জেনে রাত কাটায় জাগি
তেমনি তোমার আশায় আমার
হৃদয় আছে ছেয়ে।” (তা)
৩. বিশ্বমানবতাবাদ : বিশ্বমানবের সাথে ব্যক্তিমানবের যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবসমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বিশ্বমানবতাবাদ। তাঁর মতে, “বিশ্বমানবের সাথে মিলনের মাধ্যমেই মানুষের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে। এ মিলনের ফলেই মানবসত্তার স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটে।” তাঁর ‘Religion of Man’ পুস্তকে বিশ্বমানবতার চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, বিশ্ব ভাবের এ মহৎ আদর্শের মধ্য দিয়ে মানুষ চলে এক পরিপূর্ণতার পথে। যেদিকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, যেদিকে তার পূর্ণতা, সেদিকে ব্যক্তিগত সীমাকে ছাড়িয়ে চলেছে বিশ্বমানব।
৪. সমাজতান্ত্রিক মানবতার প্রতি সমর্থন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের উচ্চ আসনে থেকেও অবহেলিত, উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভাবতেন। তিনি তাই সর্বহারাদের পক্ষ নিয়ে অত্যাচারীদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী করেন। যেমন-
“হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।” (গীতাঞ্জলি)
তিনি সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন। তাঁর প্রবন্ধ ‘ক্যাথলিক সোশ্যালিজম’ সাধনা (১৮৯১) পত্রিকায় প্রকাশ তারই প্রমাণ দেয়।
৫. ভূমিহীনদের প্রতি মমতা : তিনি ভূমিহীনদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে তাঁর বিখ্যাত ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় তুলে ধরেন এ বাণী। যথা :
“এ জগতে হায় সেই বেশি চায়
আছে যার ভুরি ভুরি।
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।”
৬. রবীন্দ্র গল্পে মানবতা: তাঁর কিছু কিছু গল্পেও মানবতাবাদ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- সত্যানুরাগ, হৃদয়ের উদয়,প্রকৃতি প্রেম, সত্যনিষ্ঠা প্রভৃতি। এসব গল্পে রবীন্দ্রনাথ মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং মানবতার পক্ষে এক জোরালো দাবি উত্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
৭. নাইট উপাধি বর্জন: মানুষের যে কোনো অর্জন তার জীবনের শর্ত চেষ্টার ফসল, সেই অর্জনকে যদি কেউ কোনোকিছুর বিনিময়ে গ্রহণ করতে না চায় তবে বুঝতে হবে ঐ ব্যক্তির কাছে নিজের জীবনের ঐ বিশেষ অর্জনটুকুর থেকে সে যার বিনিময়ে তার অর্জনটুকু গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে তা অবশ্যই অনেক বড় কিছু। এমন একজন মানবতার কবি ও দার্শনিক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাইতো তিনি পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ ইংরেজদের নাইট উপাধি বর্জন করে মানবতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রেখে গেছেন বিশ্ব ভূমিতে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ছিল বিশ্ব মানবের বন্ধু। মানবতার জয়গান তাঁর কবিতা, উপন্যাস ও গানের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। মৃত্যুর মাত্র সাতদিন আগে তিনি লিখেন,
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ
আকীর্ণ করি,
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী।”

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*