রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেদান্ত দর্শন আলোচনা কর।

অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেদান্ত দর্শন বলতে কী বুঝ?
উত্তর।। ভূমিকা :
সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত, উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন,যাঁর জন্ম বাঙালি জাতির গর্ব, যাকে আকাশের সাথে তুলনা করা হয়, যাঁর বিস্তৃতি বিশ্বজোড়া, তিনিই হলেন বাংলাদেশ দর্শনের অগ্রসৈনিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিকদের মতো চিন্তা করেননি, অথচ তার চিন্তা যুক্তিহীন নয়। তাঁর মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম বোধশক্তি ছিল, যা তাঁর সকল কল্পনার মধ্যে মনস্বিতা সঞ্চার করেছে। অন্ধ আবেগের বদলে যুক্তিসিদ্ধ কল্পনাকে তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের বেদান্ত দর্শন : বেদের সর্বশেষ অংশ বলে উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত দর্শন। জীবন ও জগতের সত্যোপলব্ধির অদম্য প্রচেষ্টা ও দার্শনিক বিশ্লেষণ নিয়ে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে ভারতীয় দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বেদান্ত দর্শনের সূচনা হয়েছিল। ঈশ্বরের প্রেমাস্বাদনের ও আনন্দ উপভোগের আকাঙ্ক্ষাই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের গতিবৈচিত্র্যের মধ্যে প্রাণবন্ত। সৌন্দর্য সাধক রবীন্দ্রনাথ চিত্র পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর গাঢ় সৌন্দর্যের আনন্দ সুধা পান করে অমৃতলোকের তপস্যায় নিমগ্ন হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবন ও জগতের বহুত্বের মধ্যে নিজেকে বিকশিত করে নিখিলের আনন্দযজ্ঞে অংশ নিয়েছেন। ধর্মবোধ সম্পর্কে তাঁর উক্তি লক্ষণীয়, পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার পরিপূর্ণ প্রেমের সম্বন্ধ উপলব্ধিই ধর্মবোধ। জীবের জন্যই তিনি দ্বৈতভাব গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ অদ্বৈত-দ্বৈতের মুখাপেক্ষী। ব্রহ্মের আনন্দের জন্যই জগৎ ও জীবের সৃষ্টি। অসীমের মধ্যে সীমা ও প্রেম নেই; অসীম সীমার নিবিড় সঙ্গ লাভ করতে চায় প্রেমাস্বাদনের জন্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, পরমেশ্বর জীবের সংসর্গ কামনা করেন। জীব ও জগৎ ছাড়া ব্রহ্ম অপূর্ণ।
বেদান্ত দর্শন কবির জীবনের মর্মমূলে রস সঞ্জীবিত করে এক আধ্যাত্মিক অনুভূতির জগতে নিয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় অনুভবের স্পর্শে আত্মা, পরমাত্মা ও জগতের মহিমা এক ভিন্ন জীবনদর্শনে রূপ নিয়েছে। উপনিষদের সাথে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় আত্মিক সম্পর্কের প্রকৃষ্ট নিদর্শনস্বরূপ কবির উক্তিই উল্লেখযোগ্য-
“এই বিচিত্র জগৎ সংসারকে উপনিষদ ব্রহ্মের অনন্ত সত্যে, ব্রহ্মের আনন্দ জ্ঞানে বিলীন করিয়া দেখিয়াছেন।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অদ্বয়বোধে ব্যক্তিজীবনের ও মহামানবের অখণ্ডতার সাথে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনুবর্তন একই সূত্রে যথিত করে এক অনন্য জীবনদর্শন প্রতিফলিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের রচনায় দেখা যায়, ব্রহ্ম মানুষের নিকট একমাত্র মনুষ্যত্বের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা সত্যরূপে প্রত্যক্ষরূপে বিরাজমান। তিনি সর্বদেশে, সর্বকালে, সর্বজীবে ধন্য। তিনি কোনো দলের নয়, কোনো সমাজের নয়, কোনো বিশেষ ধর্মের নয়, ব্রহ্মের অন্তর্নিহিত শ্রেষ্ঠ প্রকাশ মানুষে। বেদান্ত দর্শনে জীবকে ব্রহ্মস্বরূপ বলা হয়। ব্যবহারিকরূপে প্রতিভাত জীব ব্রহ্মের সাথে ভিন্ন এবং অভিন্ন দুই-ই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব প্রকৃতিকে অখণ্ড প্রাণশক্তির মূলাধার হিসেবে উপলব্ধি করেছেন।রবীন্দ্রনাথ মায়াবাদ গ্রহণ না করে ঈশ্বরের দ্বারা যে জগৎ পরিব্যাপ্ত সে সর্বানুভূতিই সত্য বলে মনে করেন। বিশ্ব প্রকৃতির বিচিত্ররূপ সে চির সুন্দরেরই অঙ্গদ্যুতি। রবীন্দ্রনাথ তাই উপলব্ধি করেছেন, সৃষ্টির ধারার মধ্যে স্রষ্টার নিরন্তর লীলাবিলাস চলছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “পাখির কণ্ঠে আপনি জাগাও আনন্দ তুমি ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও সুগন্ধ তেমনি করে আমার হৃদয় ভিক্ষুরে, কেন দ্বারে তোমার নিত্য প্রসাদ পাওনা।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেদান্ত দর্শনের এক পর্যায়ে বলেছেন, উপনিষদ মানুষকে জীর্ণ বস্ত্র ও লোটাকম্বল নিয়ে সংসার ত্যাগী হতে অনুপ্রাণিত করেনি, এটা মানুষের প্রকৃত সত্তা উপলব্ধিতে সাহায্য করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বেদান্ত দর্শনের আধ্যাত্মিক অনুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়েও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবতাবাদী। উপনিষদের ব্রহ্ম তাঁর সমগ্র জীবন সাধনায়, চিন্তায়, ধ্যানে, কবিতায়, গানে ধ্রুবতারার মতো পথ নির্দেশ করেছে। স্বর্গালোকের ব্রহ্মত্বের মহিমা তিনি মর্ত্যভূমির মানুষের মধ্যে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন। সত্যদ্রষ্টা ঋষির মতোই রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করেছিলেন আমাদের অভাব কেবল সত্যের অভাব, আলোকের অভাব, অমৃতের অভাব, আমাদের জীবনের সকল দুঃখ পাপ নিরানন্দ কেবল এ জন্যই।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*