মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রস্তুতি পর্বের আলোচনা কর।

অথবা, মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রস্তুতি পর্বের উপর একটি নিবন্ধ লিখ।
অথবা, মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রস্তুতি পর্ব সম্পর্কে বর্ণনা কর।
অথবা, মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রস্তুতি পর্ব সম্পর্কে আলোকপাত কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ব্রিটিশ শাসকদের পরোক্ষ প্রশ্রয়ে ধর্মভিত্তিক বিভাজনের ভিতর দিয়ে যে পাকিস্তানের পত্তন ঘটল ১৯৪৭ এ, তা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য লাভজনক হলেও পুরো পাকিস্তানের অধিবাসীদের জন্য সমানভাবে শুভ হয়ে উঠেনি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে হীন মেয়ে সন্তান ছেলে সন্তানের কাছে যেমনভাবে বঞ্চিত হয়, পশ্চিমাংশের কাছে পূর্বাংশও তেমনভাবে বঞ্চিত হতে থাকলো। প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার প্রয়োজন অনুভূত হলেও আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পেরে উঠা খুব সহজসাধ্য ছিল না। তাদের
সাথে লড়তে হলে যে পরিমাণ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা দরকার সে পরিমাণ যোদ্ধা আমাদের ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রস্তুতি পর্ব : যুদ্ধক্ষেত্রে শুধুমাত্র দেশপ্রেম ও গায়ের জোর অচল। সেখানে অস্ত্রের বিপরীতে প্রয়োজন অস্ত্রের এবং অস্ত্রচালনা কৌশলের। ধারদেনা করে অস্ত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও সে অস্ত্রের ব্যবহার রপ্ত করতে না পারলে কিংবা লক্ষ্য অব্যর্থ না হলে, অন্য দেশ থেকে পাওয়া অস্ত্রের পাহাড় জমে উঠলেও বাঙালির পরাজয়ই সুনিশ্চিত হয়ে থাকতো। নিম্নে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রস্তুতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন : নারীদের মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুতি পর্বের প্রথম ছিল তাদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন। নারীদের জন্য যেসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা হয়েছিল, সেগুলো হলো- ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ, মরিচা হাউজের প্রশিক্ষণ, ধানমণ্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের পাশের বাড়িতে আয়োজিত আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণ, ধানমণ্ডি গার্লস হাইস্কুলের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।
২. প্রশিক্ষণ গ্রহণ :
ক. অস্ত্র প্রশিক্ষণ : ছাত্র ইউনিয়নই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউওটিসি মাঠে অস্ত্র প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। সিদ্ধান্ত মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডেট কোরের রুম থেকে এবং আরমানিটোলা স্কুলের তালা ভেঙে বস্তা ভরে ডার্মি রাইফেল নিয়ে আসা হয়। এখানে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবুল কাশেম মিয়া ও মুনিরুজ্জামান। নারীদের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কাজ করেন রোকেয়া কবীর।
খ. মরিচা হাউজ এ প্রশিক্ষণ : মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে সাজেদা চৌধুরীর কলাবাগানের বাসা মরিচা হাউজ এর সামনে মিসেস টি.এন রশিদের পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে নার্সিং ও অস্ত্রচালনা শিক্ষা দেয়া হতো। এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ডার্মি রাইফেল হাতে করে ২৩ মার্চ তারিখে মার্চপাস্ট করে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে যান এবং তাঁর হাতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা হস্তান্তর করেন।
গ. বেবী মওদুদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ : ঢাকায় মেয়েদের আরেক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল বেবী মওদুদের তত্ত্বাবধানে। এটি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বেবী মওদুদের উদ্যোগে ধানমণ্ডিতে একটি কমিটি গঠিত হয়। এতে বেবী মওদুদ ছাড়াও মাসুদা মতিনসহ আরো কয়েকজন মহিলা অন্তর্ভুক্ত হন। তারা ঘরে ঘরে মহিলাদের উদ্বুদ্ধ করে বর্তমান সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের পাশের একটি বাড়িতে জমায়েত করেন।
ঘ. ধানমণ্ডি গার্লস হাইস্কুলে প্রশিক্ষণ : মার্চে ধানমণ্ডি গার্লস হাইস্কুলেও একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটির আয়োজন করেছিল ধানমণ্ডির বিভিন্ন ব্লকের তরুণ ছেলেরা। এখানে প্রশিক্ষণ দেন তরু নামের একজন প্রশিক্ষক। হোসনে আরা ইসলাম ধানমন্ডি থেকে এবং নূরুন্নাহার ফয়জুন্নেসা নীলক্ষেত থেকে আরো অনেক মেয়েকে এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য নিয়ে আসতেন বলে জানা যায়।
৩. কিশোরী, যুবতী ও বয়স্ক মহিলাদের সংগঠিত করা : ঢাকা শহরেও ছাত্র ইউনিয়ন এবং মহিলা পরিষদের কর্মীগণ বিভিন্ন এলাকার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কিশোরী, যুবতী ও বয়স্ক মহিলাদের সংগঠিত করেছেন এবং প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আত্মরক্ষা, ফার্স্ট এইড, ফিজিক্যাল ফিটনেস, মার্চ পাস্ট, ট্রেঞ্জ করা প্রভৃতি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
৪. গোবরা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা : মে মাস থেকে কলকাতার পদ্মপুকুর আর পার্ক সার্কাসের মধ্যবর্তী তিলজলা এলাকায় কেবল নারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য গোবরা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয় । এ ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন সাজেদা চৌধুরী। এ প্রশিক্ষণটির অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রাথমিক চিকিৎসা, পরিচ্ছন্নতা ও পয়ঃনিষ্কাশন, মাতৃসদন ও শিশুকল্যাণ প্রভৃতি।
৫. মহিলা পরিষদ গঠন : ষাটের দশকে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে অনেক নারী ছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই ছাত্রজীবন শেষ করে মহিলা পরিষদ গড়ে তুলেছিলেন। এদের সিংহভাগই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন তথ্য প্রগতিশীল ও রাজনীতির সাথে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, কৃষক সমিতির যৌথ পরিচালনায় গেরিলাবাহিনী গড়ে তোলা হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বশিরহাট মহকুমার টাকিতে একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার নেতৃত্বে এখানে একটি নারীবাহিনী গড়ে উঠে। বাহিনীর অধিকাংশ নারীই ছিলেন ছাত্রী। এ ক্যাম্পটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রমা। বীথিকা বিশ্বাস এ দলের জন্য নারীযোদ্ধা সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ও গুপ্তচর বৃত্তির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এগুলোর
বাইরেও সারাদেশে এবং দেশের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালিত হয়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*