মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ”। এই উক্তির আলোকে রবীন্দ্রমানসের যে অভিব্যক্তি ঘটেছে, তা ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধানুসরণে বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধ অবলম্বনে রবীন্দ্রমানসের অভিব্যক্তি বিশ্লেষণ কর।
উত্তর ভূমিকা :
বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি রচনা করেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে, নিজের আশিতম জন্ম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পড়ে শোনানোর লক্ষ্যে। জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতাকে তিনি দিব্য দৃষ্টিতে অবলোকন করে তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছেন আলোচ্য নিবন্ধে। কৈশোর ও যৌবনে যে সভ্যতার মোহ তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল, বার্ধক্যে এসে তার মুখ ও মুখোশ লেখকের সম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে একান্ত নগ্নভাবে। কবি সেই উপলব্ধিজাত মূল্যায়ন ‘সভ্যতার সংকট’ শীর্ষক প্রবন্ধে নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন।
পাশ্চাত্য সভ্যতা : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর যৌবনকালে মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় পেয়েছিলেন ইংরেজ চরিত্রে তথ্য পাশ্চাত্য সভ্যতায়। বিশ্ব সাহিত্যে সে সময় বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ছিল নিতান্ত কম। তাই ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যকে জানা ও তা উপভোগ করা ছিল মার্জিতমনা বৈদগ্ধ্যের পরিচয়। সে সময় বার্কের বাগ্মিতায় মেকলের ভাষা প্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে, শেক্সপিয়রের নাটকের উৎকর্ষতায় ও বায়রনের কাব্যের মহিমায় বিশ্বসংস্কৃতির দিনরাত্রি ছিল মুখরিত। ভারতবর্ষের বিদগ্ধ মানুষেরা সনাতনী ধ্যানধারণার নাগপাশ ছিন্ন করে ইংরেজি সাহিত্যের ভাবসম্পদ আত্মস্থ করায় মগ্ন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছিলেন তা ছিল পাশ্চাত্যমুখী। তাই তিনিও পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সভ্যতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।
পাশ্চাত্য প্রীতি : আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত রীবন্দ্রনাথ ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি আত্মস্থ করার পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকেও শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের চরিত্রে মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় পেয়ে ইংরেজদেরকে দেবতুল্য ভাবতেও তিনি দ্বিধা করেননি। এ কারণে কোন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ করা যায় না। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচাকী, সূর্যসেন, প্রীতিলতারা যখন স্বাধীনতা আন্দোলন করতে গিয়ে অকাতরে প্রাণবিসর্জন দিয়েছেন তখন তিনি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মানবদরদী ইংরেজেরা স্বেচ্ছায় ভারতবর্ষ ত্যাগ করে একদিন চলে যাবে, এর জন্য সহিংস আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। তাঁদের মানবতাবাদী চরিত্রকে তিনি অবিশ্বাস করার কোন কারণ দেখেননি বলেই এই বিশ্বাস দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছিল। সে সময় তিনি সভ্য জগতের মহিমাধ্যানে একান্তমনে এমন নিবিষ্ট ছিলেন যে, সভ্য
নামধারী মানব আদর্শের অন্তরালে যে কদর্যতা থাকতে পারে তা ভাবতে পারেননি। কিন্তু এক সময় তাঁর সে ভুল ভেঙে গেল।
পাশ্চাত্য সভ্যতার নগ্নতা : ইংরেজরা ভারতবর্ষে এসেছিল বাণিজ্য করতে। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর ক্ষমতার মদমত্ততায় তারা মানবপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হলো। এক সময় দেখা গেল সমস্ত ইউরোপে তাদের বর্বরতা নখদন্ত বিস্তার করে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে। এ মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ল। পাশ্চাত্য সভ্যতার এ নগ্নতা রবীন্দ্রনাথের কল্পনার বাইরে ছিল। যখন তিনি এর মুখোমুখি হলেন তখন চরম হতাশ হয়ে বলে উঠলেন- “জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম ইউরোপের অন্তরের সম্পদ এ সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলে হয়ে গেল।”
ইংরেজ শাসনের স্বরূপ : যে যন্ত্রসভ্যতার জোরে ইংরেজ জাতি নিজের কর্তৃত্ব সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল তারা সে যন্ত্রশক্তির যথোচিত ব্যবহার থেকে ভারতবর্ষকে বঞ্চিত করল। অথচ চোখের সামনে চীন ও জাপান তা ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধি ঘটালো। ইংরেজ ভারতীয়দের পদানত করে রাখার উদ্দেশ্যে ‘Law and order’ প্রতিষ্ঠা করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করল। এর ফলে ভারতীয়রা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হলো। ইংরেজ শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট ভারতবাসীর দারিদ্র্যের যে নিদারুণ ছবি রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করলেন তা হৃদয়বিদারক। অথচ এ হতভাগ্য ভারতবর্ষ দীর্ঘকাল ধরে। ইংরেজকে ঐশ্বর্য যুগিয়েছে। ইংরেজদের এই অকৃতজ্ঞতাকে লেখক ঘৃণা ও ক্ষোভের সাথে প্রত্যক্ষ করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজের অবিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো যে পাপ তা তিনি পুনর্ব্যক্ত করতে ভুলেননি।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস : রবীন্দ্রনাথ প্রায় সারাটা জীবন ইংরেজকে বিশ্বাস করে গিয়েছেন। ইংরেজদের সভ্য শাসনকে তিনি হষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি আমাদের স্বাধীনতার সাধকেরাও বিশ্বাস করতেন যে, ইংরেজরা তাদের মহত্ত্ব ও দাক্ষিণ্যের দ্বারা ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করবে। কবি যৌবনে বিলেত গিয়ে ইংরেজ চরিত্রের যে মহত্ত্বের পরিচয় পেয়েছিলেন তাতে তিনি ইংরেজদের হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের তথাকথিত সভ্যশাসনের অন্তরালে যে সাম্রাজ্যবাদী কদর্যতার পরিচয় পেলেন তাতে তাঁর সব বিশ্বাসও দেউলে হয়ে গেল। জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে ভগ্নহৃদয় রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য ভারতের বুক থেকে নবশক্তির আবির্ভাব কামনা করলেন। এতদিন যে বিশ্বাস তিনি ইংরেজদের প্রতি রেখেছিলেন তা প্রত্যাহার করে স্বদেশবাসীর উপর স্থাপন করলেন। কারণ মানুষের উপর বিশ্বাস হারানোকে তিনি পাপ বলে মনে করতেন। তিনি আশা করেছেন প্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মোহমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এ পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দেশ ভারতবর্ষ থেকে। মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাস ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না এবং কোনকিছু লাভও করা যায় না বলেই লেখক মনে করতেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, ইংরেজদের বিশ্বাস করে রবীন্দ্রনাথ ঠকেছিলেন। কিন্তু তাই বলে তিনি দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাস হারাননি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ভারতীয়রা একদিন স্বীয় শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে দেশ ও জাতিকে স্বাধীন করবে। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোকে তিনি পাপ বলে গণ্য করতেন। তাঁর এই অভিব্যক্তি থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে তিনি দেশ ও জাতিকে গভীর বিশ্বাসে ভালোবাসতেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%ad%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a6%9f-%e0%a6%aa%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a8%e0%a7%8d/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*