মরমিদর্শন কী? লালনশাহের মরমিদর্শন ব্যাখ্যা কর।

অথবা, মরমিদর্শন বলতে কী বুঝ? লালন শাহের মরমিবাদ আলোচনা কর।
অথবা, মরমিদর্শন কী? মরমিদর্শন সম্পর্কে লালন শাহের মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী, বুদ্ধিবৃত্তির স্বাভাবিক আকর্ষণেই মানুষ জানতে চায় অজানাকে,উন্মোচন করতে চায় তার সৃষ্টি ও বৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর অপার রহস্যকে। জানতে বা উপলব্ধি করতে কিংবা একাত্ম বা মিলিত হতে চায় সেই পরম সত্তার সাথে যিনি সৃষ্টি করেছেন এ জগৎ সংসারকে। কিন্তু এ রহস্য উন্মোচন, উপলব্ধি বা মিলনের উপায় কি? এ প্রশ্নে সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে চিন্তাশীল মানুষের সুসংগঠিত চিন্তার ফসল হিসেবে যে সকল তত্ত্ব বা মতবাদের উদ্ভব হয়েছে তন্মধ্যে মরমিবাদ অন্যতম।
মরমিবাদ/মরমি দর্শন : ইংরেজি Mysticism কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ মরমিবাদ। সাধারণত দর্শনে মরমিবাদ বলতে এক ধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকেই বুঝানো হয়। এ মতবাদ অনুসারে, মরমি অভিজ্ঞতা বা স্বজ্ঞাই জ্ঞানের যথার্থ উৎস বা পদ্ধতি। এ মতে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা বা বিচারবুদ্ধি নয়, বরং মরমি অভিজ্ঞতা বা স্বজ্ঞার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় জগৎ, জীবন ও পরম সত্তাকে। এ উপলব্ধি ব্যক্তির আত্ম-অভিজ্ঞতামূলক এমন অনুভূতি যা প্রচলিত ভাষায় ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব। অর্থাৎ মরমি অভিজ্ঞতা নির্দেশ করে জ্ঞেয়বস্তুর এমন চেতনা বা গভীর অভিজ্ঞতাকে যেখানে জ্ঞাতা অতিক্রম করে যায় অভিজ্ঞতার চলমান জগতের সব বহুত্ব ও বিরোধকে এবং একাত্মবোধ করেন জগৎ, জীবন ও পরম সত্তার সঙ্গে এর জন্য দরকার কঠিন,কঠোর ও গভীর অনুশীলন বা সাধনার অব্যাহত শ্রম ও অনুশীলনের ফলে অর্জিত অভিজ্ঞতার এক পর্যায়ে জ্ঞানের সাধক লাভ করেন মরমি অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই মরমি সাধক কোন কোন বিরল মুহূর্তে বুদ্ধির পর্যায় অতিক্রম করে সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন পরম সত্তার এবং উপলব্ধি করেন তাঁর সাথে মিলনের অনবদ্য অনুভূতি।
লালন শাহের মরমি দর্শন : বাংলার মরমি সাধক ও বাউলকুল শিরোমণি লালন সাঁইজির জন্ম আনুমানিক ১৭৭৪ সালে। বাউল ও বাউল দর্শন বলতে আমরা মূলত লালনের জীবনাচার ও তাঁর গানকেই বুঝি। লালন লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে তাঁর জীবনব্যাপ্ত সাধনা দিয়ে বাউল দর্শনের ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি ছিলেন মূলত একজন স্বভাব কবি। তিনি তাঁর কবি মন দিয়ে দেহতত্ত্ব, আত্মাতত্ত্ব গুরুতত্ত্ব ইত্যাদি জটিল ভাবের গান গেয়ে তাঁর মরমি দর্শন চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন লালন তাঁর মরমিবাদী চিন্তায় মনের মানুষকে খুঁজে ফিরেছেন এবং সে পথ পরিক্রমায় তিনি ক্লান্ত
পরিশ্রান্ত তবু তিনি পথ পাড়ি দিচ্ছেন। মনের মানুষ বা পরম সত্তাকে পাবার এই ভাব বিদ্রোহী মনোভাব তাই লালন দর্শনের মূলসুর । নিম্নে লালনের মরমি দর্শনের বিভিন্ন দিক সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. দেহাত্মবাদ : মানবদেহই ছিল লালনের গান, দর্শন ও সাধনার মূলভিত্তিভূমি। লালন বিশ্বাস করতেন পঞ্চেদ্ৰীয় যুক্ত দেহ সকল শক্তির আধার এবং আধ্যাত্মিক সাধনার একমাত্র অবলম্বন, দেহের মধ্যেই সবকিছুর অধিষ্ঠান। মূলতত্ত্ব আত্মা, পরমাত্মা মনের মানুষ, পরমগুরু, পরমতত্ত্ব সবকিছু এ দেহেই মিলে। তাই লালন মানবদেহের মধ্যেই সোনার মানুষ মানুষ রতন, মনের মানুষ, নূরনবী, পরমাত্মা ইত্যাদির সন্ধান করেছেন আজীবন তাঁর গানে ও ধ্যানে। অর্থাৎ তিনি নিজের মধ্যে বা মানব দেহের মধ্যেই স্রষ্টার অস্তিত্বকে অনুভব করেছেন, আর এই পরমসত্তার অস্তিত্বের অনুভব তিনি করেছেন মরমি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কোন ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় নয়। তাইতো তার দেহভিত্তিক সাধনায় এই স্রষ্টার মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার মরমি সুর বেজে উঠে। লালনের ভাষায়
“এই মানুষে আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন
ফকির লালন বলে পেয়ে সে ধন
পারলাম না চিনতে।”
২. পরমাত্মার স্বরূপ : পরমাত্মাকে জানা এবং তাঁর মধ্যে লীন হওয়ার সাধনাই মরমি সাধকের সাধনা। বাংলার মরমি সাধনার ইতিহাসের প্রবাদসম ব্যক্তিত্ব লালন শাহও পরমাত্মা বা পরম সত্তাকে খুঁজেছেন সারাজীবন। তিনি দেহের মধ্যেই পরমাত্মার সন্ধান করেছেন। আর তাঁর এই অনুসন্ধানের সুরই বিধৃত হয়েছে তাঁর গানে যেখানে তিনি বলেছে –
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম তার পায়”
তিনি আবার বলেন,
“হায় চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি ।
ভেদ পরিচয় দেয় না আমায় ঐ খেদে ঝরে আঁখি।”
এই খাঁচা মানবদেহ, পাখি রুহ বা আত্মা, দেহের খাঁচায় জীবনব্যাপী আত্মা নামক পাখি পোষার পরও তার পরিচয় সহজে জানা যায় না। এ দুঃখে লালনের আঁখিতে অশ্রু ঝরে। পাখিরূপ আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন হওয়া দরকার। এ মিলনের জন্যই লালন সাধনার কথা বলেছেন।
৩. আত্মতত্ত্ব : মরমি দর্শনের মূলকথা আত্মতত্ত্ব। এই আত্মতত্ত্বের মধ্য দিয়েই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে লালনের মরমি দর্শনাদর্শ। লালনের মতে, মানুষের এসেন্স বা অন্তঃসার তার দেহেই নিহিত। তাঁর দর্শনে মানবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোন প্রভেদ করা হয় না। দেহ সাধনার মধ্য দিয়েই পরমাত্মার সাধনা করা যায়। দেহের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় পরম স্রষ্টাকে তাইতো লালন আত্মতত্ত্বের সাধনায় মগ্ন থেকেছেন সারাজীবন। এ কারণেই লালন বলেছেন” মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে, সে কি অন্য তত্ত্ব মানে।” তাছাড়া লালনের বিভিন্ন গানে তাঁর আত্মতত্ত্ব সাধনার অভিব্যক্তি ঘটেছে সুস্পষ্টভাবে। লালন নিজকে নিজেই সম্বোধন করে এই গানে বলেছেন-
“ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর ঘরের খবর
যাবি কোথায়?
আপন ঘর না বুঝে বাইরে খুঁজে
পড়বি ধাঁধায়।”
লালন মানব সত্তার মূলতত্ত্বে যাবার প্রেরণা পান আত্মতত্ত্ব থেকেই। তিনি পার্থিব মানব অভ্যন্তরে আবিষ্কার করেছেন অপার্থিব মানবসত্তা। তাঁর এই আত্মতত্ত্বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচিত গানের নিম্নোক্ত দুটি লাইনে—
“এই মানুষ আছেরে মন
যাবে বলে মানুষ রতন।”
এই মানুষ রতন বা পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনের প্রচেষ্টাই লালনের হৃদয়ানুভূতিকে ব্যাকুল করে তুলেছিল।কেননা লালন বিশ্বাস করতেন এই মনের মানুষকে জানলেই নিজকে জানা যায়, পরম সত্তা বা পরম পুরুষকে জানা যায়। কিন্তু একে জানা এত সহজ ব্যাপার নয়। তাকে ধরতে গেলে সে ধরা দেয় না। এই আত্মতত্ত্বের অত্যন্ত কঠিন ও দুর্বোধ্য। এই দুর্বোধ্যতারই ইঙ্গিত দিয়েছেন লালন তাঁর গানে-
“কে কথা কয়রে দেখা দেয় না
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনম ভর মেলেনা।”
তাইতো লালন একে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন অন্তরের আলোকে অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় স্বাক্তিক বা মরমি অভিজ্ঞতার আলোকে আর এখানেই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মরমি চিন্তাধারা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, লালন শাহ ছিলেন মরমি সাধন। তাঁর চিন্তা, গান ও সাধনায় মরমিবাদেরই প্রকাশ ঘটেছে। কেননা তাঁর দর্শন ও গানে আমরা মানব আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের সুরই শুনতে পাই, যে মিলনের পথ অন্তরের গভীর স্বাজ্ঞিক অনুভূতিজাত, ইন্দ্রিয়ানুভূতি জাত নয়। আর মানবতার সাথে পরমাত্মার মিলনের এই ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতিই তাঁর মরমি দর্শনকে মহিমান্বিত করেছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-2/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*