ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে নারী সংগঠন ও নারী আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর

অথবা, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে নারী সংগঠন ও নারী আন্দোলন সম্পর্কে বর্ণনা কর।
অথবা, উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিকাশে নারী সংগঠন ও নারী আন্দোলনের বিকাশ সবিস্তারে উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় উপমহাদেশে নারী আন্দোলন ও নারী নেতৃত্ব শুরু হয় বিংশ শতকের ২০ এর দশকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৈষম্য ও শোষণমূলক নানাবিধ কর্মকাণ্ডে যে ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা ও বিদ্রোহের সূচনা হয় তারই ধারাবাহিকতায় নারীদের সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হয় এবং গড়ে ওঠে নারী নেতৃত্ব। তবে উপমহাদেশে রাজনৈতিক সহিংস আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার পূর্বে শিক্ষা ও সচেতনতামূলক সামাজিক আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ঘটেছে। ধর্মীয় কুসংস্কার হতে মুক্তির জন্য গড়ে ওঠা সামাজিক সংগঠনগুলোই পরবর্তীকালে নারীর সার্বিক মুক্তি ও রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তিত হয়েছে এবং অসংখ্য বিদুষী নারী নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন।
নারী সংগঠন ও নারী আন্দোলন : ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত নারী সংগঠন ও নারী আন্দোলনসমূহ পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে বিকাশ ঘটিয়েছে, তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ১৯১৯ সাল : লেডি অবলা বসু নারী শিক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।
২. ১৯২০ সাল : কলিকাতা কংগ্রেসে প্রথম নারী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠিত হয় জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে।
৩. ১৯২১ সাল : কবি কামিনী রায়, লেডি অবলা রায় প্রমুখ বঙ্গীয় নারীসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত সালে ‘নারী কর্মমন্দির’ গড়ে তোলেন উর্মিলা দেবী।
৪. ১৯২৩ সাল : আশালতা সেন ঢাকায় ‘গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি’ গড়ে তোলেন।
৫. ১৯২৪ সাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ ‘দীপালী সংঘ’ গড়ে তোলেন। ‘জয়শ্রী’ ছিল তাঁদের পত্রিকার নাম। তাঁরা ১২টি অবৈতনিক স্কুল গড়ে তোলেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ বর্তমান শেরে বাংলা গার্লস কলেজ।
৬. ১৯২৫ সাল : ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন ইন ইন্ডিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘স্ত্রী ধর্ম’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় সর্বভারতীয় নারী সংগঠন কর্তৃক।
৭. ১৯২৭ সাল : সরোজ নলিনী দত্ত মেমোরিয়াল এসোসিয়েশন, উইমেন এডুকেশন লীগ, অল ইন্ডিয়া উইমেন্স
কনফারেন্স গঠিত হয়।
৮. ১৯৩০ সাল : সিলেটে ‘শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয় জোবেদা খাতুন চৌধুরীর নেতৃত্বে।
৯. ১৯৩২ সাল : নারী ও বালিকা পাচার রোধে আইন প্রণয়নের দাবিতে ‘অল বেঙ্গল উইমেন্স ইউনিয়ন’ গঠিত হয়।
১০. ১৯৩৩ সাল : বিলাতি পণ্য বর্জন, মদ্যপান রোধ, নারী সমাবেশ করার জন্য ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠিত হয় ।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে নারী : নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ১৯১৪-১৯৪৭ সাল : এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, যা বর্তমানে নারী নেতৃত্বের ইঙ্গিত প্রদান করে।
২. ১৯১৪ সাল : দু’কড়ি বালা দেবী, চারুশিলা দেবী, ননীবালা, মোহিনী দেবী এ সময় থেকেই কাজ করেছেন।
৩. ১৯২৮ সাল : সুভাষ চন্দ্র বসুর কর্মকাণ্ডের সমর্থনে লীলা নাগ কলিকাতা কংগ্রেসে যোগ
ন।
৪. ১৯৩০ সাল : আশালতা সেন, লীলা নাগ ঢাকায় লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন।
৫. ১৯৩০ সাল : মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শের অনুসারী প্রীতিলতা স্বদেশী আন্দোলনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন।
৬. ১৯৩২ সাল : রাজিয়া খাতুন ও হালিমা খাতুন ময়মনসিংহের বিপ্লবী যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে কাজ করেছেন।
৭. ১৯৩৮-৩৯ সাল : জমিদারের স্বেচ্ছাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সিলেটের নারীরা নানকার আন্দোলনে যোগ দেন।
৮. ১৯৪২ সাল : বোম্বেতে ব্রিটিশ পুলিশের জুলুম উপেক্ষা করে অরুণা আসফ আলী স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।
৯. ১৯৪৬ সাল : তেভাগা আন্দোলন শুরু হলে তাতে নারী কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও শহীদ হওয়া ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দিপেশ্বরী সিং, বুড়িমা, সুরমা সিং, সরলাদি, যশোদা রানী সরকার, কৌশল্যা কামরানী প্রমুখ শত শত নারী এ সময় কৃষক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন।
১০. ১৯৪৬ সাল : প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে কয়েকজন বাঙালি নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
১১. ১৯৪৭ সাল : লীলা নাগ ও তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী কবি সুফিয়া কামাল দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নারীসমাজের সংগঠন, আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে নেত্রী হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
১২. ১৯৪৭ সাল : পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৩. ১৯৫২ সাল : ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনে নারীসমাজের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। সিলেটে মুসলিম লীগের জেলা কমিটির সভানেত্রী জোবেদা খাতুন চৌধুরী, সৈয়দা নজিবুন্নেছা ও রাবেয়া খাতুন প্রমুখ এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৪. ১৯৫৪ সাল : নির্বাচনের আইন ছিল পৌরসভা এলাকায় নারীদের ভোটে নারী প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। সে সময় ১৪ জন নারী প্রার্থী নির্বাচিত হন এবং তাদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
১৫. ১৯৫৫ সাল : নির্বাচিত ১৪ জন নারী প্রার্থীর মধ্য থেকে বেগম দৌলতুন্নেছা, নূরজাহান মুরশিদ, বেগম রাজিয়া বানু প্রাদেশিক সরকারের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী হিসেবে নিযুক্ত হন ।
১৬. ১৯৬০-৬১ সাল : সর্বপ্রথম একজন নারী জাহানারা আখতার ডাকসুর সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
১৭. ১৯৬৩-৬৪ সাল : অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৮. ১৯৬৭-৬৮ সাল : মাহফুজা খানম ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯. ১৯৭০ সাল : পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয় কবি সুফিয়া কামালকে সভানেত্রী ও মালেকা বেগমকে সাধারণ সম্পাদক করে।
২০. ১৯৭২ সাল : বাংলাদেশ সংবিধানে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়।
২১. ১৯৭৩ সাল : দু’জন নারী মন্ত্রিসভায় নিযুক্ত হন। যার মধ্যদিয়ে ক্ষমতায়নে নারীর আগমন ঘটে
২২. ১৯৭৭ সাল : প্রথম সরকারি অধ্যাদেশের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে ২ জন নারী সদস্য মনোনয়নের বিধান করা হয়।
২৩. ১৯৭৮ সাল : মহিলা মন্ত্রণালয় ও মহিলামন্ত্রী নিয়োগ করা হয়।
২৪. ১৯৮১ সাল : ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
২৫. ১৯৮২ : ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী দলের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলীয় নেতৃত্ব লাভ করেন।
২৬. ১৯৮৪ সাল : নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদ (সিডও) এর কিছু ধারা সংরক্ষণসহ সরকারের স্বীকৃতি দান ।
২৭. ১৯৮৬ সাল : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা সংসদে “বিরোধীদলের নেতা নির্বাচিত হন।
২৮. ১৯৮৮-৮৯ সাল : শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া যুগপৎ কর্মসূচির মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
২৯. ১৯৯০ সাল : গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীরাই প্রথম কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করেন, সেই মিছিলে হাজার হাজার ছাত্রজনতা যোগ দেন এবং স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
৩০. ১৯৯১ সাল : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জয়লাভ করে এবং খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে সরকার গঠন করে। এর মধ্যদিয়েই বাংলাদেশে মহিলা প্রধানমন্ত্রীত্বের সূচনা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের
মধ্যদিয়ে শেখ হাসিনাও প্রধানমন্ত্রীত্বের স্বাদ গ্রহণ করেন।
৩১, ২০০১ সাল : ২০০১ সালের নির্বাচনে বি.এন.পি পুনরায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, নারীরা ইতিহাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। তেভাগা আন্দোলনে ইলামিত্র, ঔপনিবেশিকতা আন্দোলনে প্রীতিলতা, বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণে বেগম রোকেয়া, মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবি, মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে জাহানারা ইমাম প্রমুখ ব্যক্তির কথা এক্ষেত্রে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারি। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মতো নেত্রীর উপস্থিতিও গুরুত্বের দাবিদার। এ উপমহাদেশে নারী নেতৃত্বের শীর্ষে যেসব নারীর আবির্ভাব ঘটেছে তারা সকলেই উত্তরাধিকার সূত্রে এসেছে এমন একটি ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। কথাটা আংশিক সত্যি হলেও এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে
পুরুষরাও একই রকম ধারায় ক্ষমতায় এসেছে। নারীরা কেবলমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রেই সবসময় ক্ষমতায় আসেনি। তারা ধীরে ধীরে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*