ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নারীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে যা জান লিখ ।

অথবা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নারীর সম্পৃক্ততার বিভিন্ন দিক তুলে ধর।
অথবা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নারীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নারীর সম্পৃক্ততার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
কমরেড মনি সিংহ আজীবন দেশের বিভিন্ন সংগ্রাম ও আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর দেখা এদেশের নারীরা কত দৃঢ় চেতনায় এবং অকুতোভয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। তারা
আন্দোলনকে দিয়েছেন গতি, আন্দোলনে সঞ্চার করেছেন প্রাণ। শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত হতে আগত এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এসব বিপ্লবী চিন্তাধারার কর্মীরা অত্যন্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের নারীদের এক বিরাট অংশ তেভাগা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। শুধু যে তারা ভলান্টিয়ার ছিলেন তাই নয়, তাদের মধ্যে দুর্ধর্ষ ও কৌশলী নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছিল।স্বাধীনতা যুদ্ধেও নারীর অংশগ্রহণ ছিল বিপুল পরিমাণে। আশ্রয় দিয়ে, আর্থিক সাহায্য দিয়ে, খাদ্য দিয়ে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
বিভিন্ন আন্দোলনে নারীর সম্পৃক্ততা : বিভিন্ন আন্দোলনে নারীরা সম্পৃক্ত ছিল, আজও আছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সুসং জমিদারদের ক্ষেত্রে : বাংলাদেশের এক সময়ের সুসং নামক জমিদারদের আয়ের মূল ক্ষেত্র ছিল গারো পাহাড়। তাদের সমতল ভূমির আয়ের দিকে নজর অপেক্ষাকৃত কম ছিল। তালুকদারি, নিষ্কর প্রভৃতি সম্প্রদায়ের জন্য সমতল ভূমির এক বড় অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ব্রিটিশ আমলে গারো পাহাড় হস্তচ্যুত হওয়ায় সুসং রাজা অন্য দশটি
জমিদারির মতো আর একটি জমিদারিতে পরিণত হলো। তবে সুসং রাজাদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব তীব্র আকার ধারণ করে। প্রকাশ্যে তাঁরা ছিলেন ব্রিটিশ ভক্ত, কিন্তু মনে ছিল তাদের ব্রিটিশবিরোধী আগুন। এ মানসিকতা তারা কোন দিন ভুলতে পারেননি। যার জন্য নারীরা এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।
২. হাজং উপজাতি ক্ষেত্রে : হাজং উপজাতিদের ‘সুসং’ রাজ্যের গোড়াপত্তনের পর খুব সম্ভব আসাম থেকে আমদানি করা হয়েছিল। এরা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কামাখ্যা ছিল তাদের জাগ্রত দেবতা। গারো পাহাড়ের পাদদেশে এদের বসানো হয়েছিল। এরা ছাড়াও ডালু, কোচ, রাজবংশী, গারো প্রভৃতি বর্ণের উপজাতি গারো পাহাড়ের পাদদেশে বাস করতো হাজংরা ছিল সৎ, সাহসী ও দুর্ধর্ষ। এদের গারো পাহাড়ের পাদদেশে বসানোর উদ্দেশ্যে ছিল উভয় দিক হতে হামলা প্রতিরোধ করা।
৩. ভলান্টিয়ার বাহিনী : ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। বিপুল সংখ্যক হাজং উপজাতি মেয়েরা পিঠে তাদের শিশু সন্তান বেঁধে সত্তর-আশি মাইল হেঁটে এসেছিলেন। ক্লান্ত এসব মেয়েদের পথে খাবারের অবশ্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাছাড়া ছিল হাজংদের এক বিরাট ভলান্টিয়ার বাহিনী । কিশোরগঞ্জ থেকে দীর্ঘ পথ হেঁটে হিন্দু ও মুসলমান কৃষকের এক বিরাট বাহিনী এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। এছাড়া ঢাকা জেলা থেকেও
কৃষক ও নারী বাহিনী এসেছিল। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মীবাহিনী ও নেতারা এসেছিলেন।
৪. রাজবংশীদের ক্ষেত্রে : রাজবংশী মেয়ে ভাণ্ডনী পুলিশের এক সদস্যের হাত থেকে বন্ধুক ছিনিয়ে নিয়ে তাকে সারারাত এক ঘরে আটকে রাখেন। দিনাজপুরের রানী শংকাইলের রাজবংশী কৃষকবধূ জয়মনির প্রতাপ ছিল দোর্দণ্ড। তাঁর দলের আক্রমণে অনেক সময় পুলিশ পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি নামমাত্র লেখাপড়া জানতেন। তারপরেও সম্মোহনী নেতৃত্ব আন্দোলনকে বেগবান করে। এ সময় এমন আরেকজন নেত্রী ছিলেন দিনাজপুরের দীপপুরি। তিনি তার অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ভলান্টিয়ারদের উৎসাহ দিয়ে নিজেই লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে পুলিশকে আক্রমণ করেন। পুলিশ নারী কর্মীদের আক্রমণে পিছু হটে পলায়ন করে।
৫. তেভাগা আন্দোলনের ক্ষেত্রে : নারী আন্দোলনের অগ্রদূত কৃষক আন্দোলনের একজন দুর্ধর্ষ নেত্রী ছিলেন সরলাদি । তিনি ছিলেন এক নমশূদ্র কৃষক রমণী। যশোরের নড়াইল জেলায় যে তেভাগা আন্দোলন গড়ে উঠে তার কেন্দ্র ছিল উক্ত জেলার বাকড়ি গ্রাম। সরলাদি ২৫০-৩০০ মেয়ের একটি ‘ঝাঁটা বাহিনী’ সংগঠিত করেছিলেন। ঝাঁটার মুখে
দু’দু’বার পুলিশ মাফ চেয়ে সরে পড়ে। ভলান্টিয়ার বাহিনী জনসাধারণকে ঢাল, সড়কি নিয়ে পাহারা দিত। অনেক সময় পুলিশ তাদের ব্যূহ ভেদ করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেত। পুলিশ সরলাদিকে ধরার জন্য বহুবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই তিনি চতুরতার সাথে ফাঁকি দিয়েছেন পুলিশের বেষ্টনী। সরলাদি আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু তার বিস্ময়কর কাহিনী সেখানকার কৃষকরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে এখনো। তার আদর্শ নারীসমাজকে দেয় প্রেরণা ও সাহস।
৬. নেত্রকোনার ভূ-স্বামী ও চাষি প্রসঙ্গে : তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে নেত্রকোনার ভূ-স্বামীগণ ছিল বেশিরভাগ হিন্দু এবং ভাগচাষিরা অধিকাংশ মুসলমান। ভাগচাষিরা ছিল অত্যন্ত গরিব। অন্যান্য জায়গার ন্যায় এখানে পুলিশ টহল দিয়ে বেড়াত। ভাগচাষিদের এক সদস্যকে পুলিশ নির্মমভাবে প্রহার করেছিল। ভাগচাষিদের মেয়েরা গরিব ছিল। রাজবংশী নমশূদ্র মেয়েদের ন্যায় তারা বের হতেন না। তাঁরা পর্দার আড়ালে থাকতেন ও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কৃষকদের উপর জমিদারদের নির্যাতন, হয়রানিই নারীদেরকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে তোলে। জমিদাররা কৃষকসভার কর্মীদের খুন করার ষড়যন্ত্র করলে তা ফাঁস হয়ে যায়। জমিদাররা মন্ত্রী, আমলা, উকিল প্রভৃতির সাথে পরামর্শ করে, নানকারদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করলো। আসামি খোঁজার নাম করে ব্যাপক লুঠপাট, মারধর শুরু করে দিল। এ বিভীষিকার সৃষ্টি হলে জনমতের সাহায্যে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য কৃষকসভা এক অভিনব পথ অবলম্বন করলো। লাঞ্ছিতা, অপমানিতা নানকার মহিলারা এক দীর্ঘ মিছিল নিয়ে জেলা সদরে উপস্থিত হলেন। ধীরে ধীরে গ্রামবাংলার সর্বস্তরের সকল নারী পুরুষ পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে ও জনমত সৃষ্টি করে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*