বৈষ্ণব দর্শনের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বৈষ্ণবীয় উদারতাবাদ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
অথবা, বৈষ্ণবীয় উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় উদারতাবাদ সম্পর্কে যা জানো লেখ।
উত্তর৷। ভূমিকা :
মধ্যযুগের বাংলার বর্ণবিভক্ত হিন্দুসমাজের এক ক্রান্তিলগ্নে মহানপুরুষ শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন মুক্তির অমোঘ বাণী নিয়ে। তৎকালীন হিন্দুসমাজ কুসংস্কার, জাতিবর্ণ বিভেদ, ব্রাহ্মণ্যবাদের বাড়াবাড়ির যাঁতাকলে যখন প্রায় ধ্বংসোন্মুখ ঠিক সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সনাতন হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে প্রেমভক্তি ও মানবতার উদাত্ত আহ্বান নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য দেব। তাঁর প্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম বা প্রেমদর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ, মানুষের সার্বত্রিক কল্যাণ । মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বা প্রেমের বিস্তৃতি। এ ধর্মে জাতির প্রতি জাতির বিদ্বেষ ও অবিচার এবং এক ধর্মের সঙ্গে অপর ধর্মের বিভেদের কোন স্থান ছিল না। অর্থাৎ উদারতাবাদকেই বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শন মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
বৈষ্ণব দর্শনের উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি : উদারতাবাদ বলতে এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝায় যেখানে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও কল্যাণকে মহামূল্যাবান মনে করা হয়। অর্থাৎ জাতিধর্মবর্ণ, উঁচুনীচু নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান সুযোগ ও মর্যাদার স্বীকৃতিই উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সারকথা। মানুষে মানুষে বিভেদ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংকীর্ণ জাতিচেতনা ইত্যাদিতে উদারতাবাদী দৃষ্টিতে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শন তথা বৈষ্ণববাদের আদর্শিক দিক পর্যালোচনা করলে এ মতবাদে উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের মূল লক্ষ্যই ছিল মানুষের মুক্তি এবং তার জন্য যে পথ অবলম্বন করা মানুষের উচিত সে দিকনির্দেশনা দেয়া। কোনো প্রকার সংকীর্ণ চিন্তা চেতনা বৈষ্ণববাদে স্থান পায়নি। বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের মতাদর্শের দ্বার সকলের জন্য ছিল উন্মুক্ত। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ তখনকার সময়ে বিদ্যামান সকল ধর্মের অনুসারীদের জন্য এ দর্শন পাঠ অনুধাবন ও পর্যালোচনার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এ দর্শনের যুক্তি ও চিন্তা চেতনা এতোই অকাট্য ছিল যে, কোনো সংকীর্ণতার মধ্য দিয়ে এ দর্শন প্রচার করতে হয় নি। তাদের এ উদার দৃষ্টিভঙ্গি সবাইকে তখন বিস্মিত করেছিল। কারণ মধ্যযুগের সাধারণ মানুষ ছিল সংকীর্ণ
মানসিকতায় আবদ্ধ এবং তাদের কাছে যেসব মতবাদ উপস্থাপন করা হতো তাও ছিল তাদের মনসিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু চৈতন্য সেই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে দিলেন অমৃতের সন্ধান যার মাধ্যমে মানুষ পেল পরম চেতন সত্তাকে লাভ করার সুমসৃণ পথ। তিনি এমন দর্শন জনগণের কাছে প্রচার করলেন যেখানে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ ছিল না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, সকল জীবই পরমস্রষ্টা ভগবানের সৃষ্টি। তাই তাঁর সৃষ্ট জীবকে অবহেলা বা অবমূল্যায়ন করা ঠিক নয়। এ যুক্তিতেই তিনি সিদ্ধান্তে পৌছে ছিলেন যে, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষই
সমান এবং সবাইকে একই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। অর্থাৎ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে কোনো প্রকার প্রশ্রয় না দিয়ে চৈতন্য মানুষের মন থেকে ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেশ কাল পাত্রের সব ভেদাভেদ। চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের এ উদার দৃষ্টিভঙ্গিই মধ্যযুগের সাধারণ মানুষকে দিয়েছিল স্বস্তির সুবাতাস এবং এ কারণেই দলে দলে মানুষ সমবেত হয়েছিল তাঁর ভাবাদর্শে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে দেখা যাচ্ছে জাত, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় চেতনার উর্ধ্বে একটি সর্বাঙ্গীন মানব কল্যাণকামী উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের মূলসুর। এ কারণেই বৈষ্ণব মতাদর্শ হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে মধ্যযুগের জনতাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*