বৈষ্ণব দর্শনের বিরুদ্ধে কী ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হতে দেখা যায়? এগুলো কী গ্রহণযোগ্য?

অথবা, বৈষ্ণব দর্শন, দর্শন প্রতিপাদ্য নয় বলে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয় সেগুলো
আলোচনা কর।
অথবা, বৈষ্ণব দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো মূল্যায়ন কর।
অথবা, বৈষ্ণব দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ এবং তার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, বৈষ্ণব দর্শন সম্পর্কে সমালোচকরা কি কি অভিযোগ করেছেন? সেগুলো কি গ্রহণযোগ্য।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বৈষ্ণব ধর্মমতের সার বা তত্ত্ব কথা নিয়েই গড়ে উঠেছে বৈষ্ণব দর্শন। বিষ্ণুর উপাসকরাই ।এ মতে ঈশ্বরকে বিষ্ণু বা নারায়ণ, হরি বা কৃষ্ণ বলা হয়। তাঁর নামই একমাত্র উপাস্য। বৈষ্ণব সমাজ বিষ্ণুর নাম সংকীর্তন ও নাম জপকে আধ্যাত্ম সাধনার প্রধান অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই বৈষ্ণব মতে দর্শন থেকে ধর্মের প্রাধান্যই বেশি। অর্থাৎ বৈষ্ণব মতের প্রেমভক্তিবাদ প্রধানত ঈশ্বর সাধনার সাথে যুক্ত। যুক্তি তর্কের কসরতে কোনো বিশুদ্ধ দর্শন তত্ত্ব এ মতে নির্মিত হয়নি। তাই অনেকে বৈষ্ণব মতকে দর্শন পদবাচ্য বলতে রাজি নন।
বৈষ্ণব দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ : দর্শন হচ্ছে জগৎ ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত সমস্যাবলির যুক্তিযুক্ত সমাধানের প্রয়াস ও তার মূল্যায়ন। অর্থাৎ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভের প্রচেষ্টাই হচ্ছে দর্শন।বিশুদ্ধ যুক্তির উপস্থিতি ছাড়া দর্শন কোনো কিছুকেই স্বীকার করে না। কিন্তু বৈষ্ণববাদের দিকে তাকালে দেখা যায় এখানে যুক্তি থেকে প্রেমভক্তির প্রাধান্যই বেশি বা কৃষ্ণ বন্দনাই বৈষ্ণববাদের মূলমন্ত্র। তাই অনেকেই বৈষ্ণব মতকে দর্শন বলার বিপক্ষে নানা যুক্তি বা অভিযোগ উত্থাপন করেন। নিম্নে বৈষ্ণব দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত কতিপয় অভিযোগ এবং এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আলোকপাত করা হলো :
১. অনেকে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন যে, সমকালীন বিশ্লেষণী মানদণ্ডের বিচারে বৈষ্ণবীয় রসতত্ত্ব ও প্রেমভক্তিবাদকে যথার্থ দর্শন বলা যায় না। কারণ বিশ্লেষণী দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শন বলতে যা বুঝায় বৈষ্ণব দর্শনে তার কোনো লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না। এখানে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণী নয় বরং ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির প্রাধান্যই লক্ষণীয়। বৈষ্ণব দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এ অভিযোগ একেবারে অমূলক তা হয়তো বলা চলে না। কিন্তু তাই বলে এ অভিযোগকে অকাট্যও বলা চলে না। বৈষ্ণব দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এ
অভিযোগের একটি চমৎকার জবাব আমরা দেখতে পাই ড. আমিনুল ইসলামের “বৈষ্ণব দর্শন ও মানবতাবাদ” প্রবন্ধে। তাঁর মতে, “সমকালীন বিশ্লেষণী মানদণ্ডের বিচার বৈষ্ণবীয় রসতত্ত্ব ও প্রেমভক্তিবাদকে যথার্থ দর্শন বলা যায় কি না। এ নিয়ে বিশদ আলোচনা ও তর্ক বিতর্কের অবকাশ হয়তো আছে। তবে এরকম কোনো বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যুক্তিতর্কের তত্ত্বীয় কসরত ছাড়াও মানবিক বলে দর্শনের যদি অপর একটি দিক – থেকে থাকে তাহলে বৈষ্ণববাদ জীবনমুখী ও মানবধর্মী দার্শনিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বটে।”
২. বৈষ্ণব দর্শনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলা হয় যে, বৈষ্ণববাদে দার্শনিক যুক্তিবিচারের চেয়ে আবেগ উচ্ছ্বাস ও মিস্টিক অনুভূতির প্রাধান্যই বেশি। তাই বৈষ্ণববাদকে দর্শন না বলে ধর্মমত বলাই অধিকতর যুক্তিসংগত। এ সত্য হয়তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বৈষ্ণব ভাবধারা একটি বিশুদ্ধ দর্শন ধারা নয় বরং তা মিশ্রিত হয়ে আছে ধর্ম তাত্ত্বিক রসতাত্ত্বিক সাহিত্য ধারার সঙ্গে। কিন্তু এ মিশ্রণ এমন যে তাদের কোনো একটিকে অন্য একটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। ধর্ম ও দর্শনের এ সম্মিলিত পথ চলার নিদর্শন দর্শনের ইতিহাসে একেবারে কম নয়। সমগ্র মধ্যযুগের পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে খ্রিস্টধর্ম। শুধু মধ্যযুগ কেন বুদ্ধিবাদী ও বিচারবাদী বলে পরিচিত আধুনিক পশ্চাত্য দার্শনিকদের উপরও ধর্মের প্রভাব একেবারে কম ছিল না। ডেকার্ট এবং কান্টের মতো প্রখ্যাত আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিকের চিন্তায়ও ধর্মের প্রভাব দেখা যায় সুস্পষ্ট। মোটকথা, দর্শনের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় ধর্ম সাহিত্য ও দর্শন পথ চলেছে
হাতে হাত রেখে। আসল কথা ধর্ম, সাহিত্য ও দর্শনের মূল উপজীব্য যেখানে মানুষ ও মানব কল্যাণ সেখানে এদের মধ্যে বিরোধ টানাটাই অযৌক্তিক। অতএব ধর্মের দোহায় দিয়ে বৈষ্ণব দর্শনকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
৩. অনেকে মনে করেন যে, বৈষ্ণব মত ও এ মতের প্রবর্তন শ্রীচৈতন্য কীর্তনের গানে নাচে বাঙালি জাতিকে নির্বীর্য করে গিয়েছেন। অর্থাৎ ভক্তিভাবোচ্ছ্বাস পেয়ে বাঙালি জাতি সংগ্রামভীরু ও জীবনধর্মে পলাতক হয়েছে। এ ধর্ম দর্শনের প্রভাব মানুষকে জীবনবিমুখ করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, অভিযোগের উত্তরে সুকমার সেন বলেন, চৈতন্য বা তাঁর প্রবর্তিত মত বাঙালিকে নির্জীব করেনি। বরং বলতে পারা যায় চৈতন্য বাঙালিকে একটা বৃহৎ উদ্যমের পথ খুলে দিয়েছিলেন। কেননা, চৈতন্যের বৈরাগ্য ধর্ম কর্মবিমুখ ভিক্ষুকের আলস্য নয়। এ ধর্ম অত্যন্ত কঠিন বীর্যবানেরই আচরণীয় নৈষ্কর্য্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*