অথবা, বৈষ্ণবীয় গুরুতত্ত্ব কি?
অথবা, বৈষ্ণবীয় গুরুতত্ত্ব বলতে কি বোঝানো হয়?
অথবা, বৈষ্ণবীয় গুরুতত্ত্ব কি বোঝ?
অথবা, বৈষ্ণবীয় গুরুতত্ত্ব কাকে বলে?
উত্তর৷। ভূমিকা : কৃষ্ণ বা হরিনাম জপ-কীর্তনই বৈষ্ণব ধর্ম ও সাধনার মূলমন্ত্র। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচৈতন্য দেব হরিনাম উপদেশ দিয়ে সাধারণ মানুষকে ঈশ্বরাভিমুখ করে তাদের জীবন মননের মান উন্নত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন সংসারের সবরকম সুখভোগ আকণ্ঠ নিমগ্র থেকে শুধু হরিনাম করলেই ইহজীবন সার্থক ও পরলোকে মুক্তি লাভ সম্ভব। এক্ষেত্রে ভগবান ও ভক্তের সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ এতে তৃতীয় কেউ বা গুরুর
প্রয়োজন নেই। যদিও চৈতন্যের গুরু ছিল তথাপি গুরু বিনা জীবের মুক্তি নেই- একথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু চৈতন্যের তিরোধানের পর গুরু বৈষ্ণব সাধন তত্ত্বে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেয়।
বৈষ্ণব গুরুতত্ত্ব : সাধারণভাবে আধ্যাত্মিক সাধন পথের পথপ্রদর্শককে বলা হয় গুরু। যিনি যা যারা সাধনার মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতার দ্বারা আধ্যাত্মিক সত্য লাভ করেছেন তিনি বা তাঁরাই গুরু। বাংলার বাউলরা যে অর্থে গুরুবাদী দর্শন সম্প্রদায় বৈষ্ণবরা সে অর্থে গুরুবাদী সম্প্রদায় কি না তা নিয়ে অবশ্যই বিতর্কের অবকাশ আছে।কেননা, চৈতন্য ভক্তরা তাঁকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বা কৃষ্ণাবতার বলে জ্ঞান করতেন। তাই গুরু পদবাচ্যটি তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। তবে চৈতন্য এবং তাঁর দুই প্রধান সহচর নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতের তিরোধানের পর বৈষ্ণব মতে গুরুর গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে গেল। চৈতন্যের গুরু ছিল। তাঁর পরমগুরুর নাম মাধবেন্দ্র পুরী বলে আমরা জানতে পাই। চৈতন্য জীবিতকালে গুরুর এবং গুরুর কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করতেন। তবে বিনা গুরু-করণে যে জীবের মুক্তি নাই এমন কথা তিনি কখনো বলেননি। গুরুহীনেরও আধ্যাত্ম পথে অগ্রাভিসার তিনি স্বীকার করতেন। একথা চৈতন্য শিক্ষাচ্ছ্বলে সনাতনকে বলেছিলেন এভাবে-
“জীবে সাক্ষাৎ নাহি তাহে গুরু চৈত্ত রূপে
শিক্ষাগুরু হন কৃষ্ণ মহান্তস্বরূপে।”
অর্থাৎ চিত্তে যেখানে আপনিই আলো জ্বলে উঠে সেখানে গুরু আলেখ্য বা চৈত্ত্য’ মহান্তরূপে কৃষ্ণই শিক্ষা দেন। অর্থাৎ চৈতন্য বলতে চান যে, কৃষ্ণই গুরু, মানুষরূপে হোক অরূপে হোক মনের উদ্ভাসে হোক। চৈতন্যের নির্দেশে সনাতন ও রূপ যে ভক্তি শাস্ত্র রচনা করেন তাতে গুরুর প্রাধান্য সুস্পষ্ট। ঈশ্বর বা ভগবানের পরেই গুরুর স্থান। চৈতন্যের ধর্মে শুধু ভক্ত ও ভগবান, মাঝখানে কেউ নেই, কিছু নেই। এখন মাঝখানে আসলেন গুরু, ভগবান আর ভক্তের প্রিয় বা প্রেমিক রইলেন না। ভক্তের স্থান নিলেন রাধা। রাধাকে নিয়ে কৃষ্ণের লীলা। সেই লীলার সহায়ক গুরু। প্রথম শ্রেণিতে গুরু সখী এবং সখীরা গোপী রাধার অংশ। দ্বিতীয় শ্রেণিতে গুরু সখী সহায়ক ‘মঞ্জুরী’ বা সেবাদাসী’ সখীরা অপ্রাকৃত, মঞ্জুরীরা মহাগুরু স্থানীয়। মহাস্তগুরু হচ্ছেন মঞ্জুরীদের অনুগৃহীত। তিনি শিষ্য সাধককে মঞ্জুরীর অনুগ্রহ লাভ করতে সহায়তা করেন। মঞ্জুরীর কৃপা হলে সিদ্ধ দেহ পেয়ে সাধক ব্রজে রাধাকৃষ্ণের সেবা রসের আস্বাদন করেন ও মঞ্জুরীপ্রাপ্ত হন। সখী মঞ্জুরীর অনুগ্রহ ছাড়া কৃষ্ণ প্রাপ্তির কোনই উপায় নাই। এ ক্ষণে এসে বৈষ্ণবরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে কৃষ্ণের উপাসনা ও গুরু সেবা দ্বারা মানুষ মায়ার বন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে কৃষ্ণপদ লাভ করতে পারে। অর্থাৎ বৈষ্ণব মতে মঞ্জুরীতত্ত্ব বা গুরুতত্ত্ব গৃহীত হয়। ভক্ত ও ভগবানের মাঝখানে গুরু আসন পেতে বসেন। চৈতন্যের শীর্ষস্থানীয় সহচররা মঞ্জুরীতত্ব লাভ করেন। যেমন, রূপ ‘রূপমঞ্জুরী’, সনাতন ‘রতিমঞ্জুরী’, রঘুনাথদাস ‘রসমঞ্জুরী’, জীব ‘বিলাসমঞ্জুরী’ বাংলাদেশের বৈষ্ণব মহান্ত জাহ্নবা দেবী ‘অনঙ্গমঞ্জুরী’ ইত্যাদি সিদ্ধ নাম প্রাপ্ত হন। একসময় এসে বাংলায় দুটি গুরু সম্প্রদায় বেশ প্রাধান্য বিস্তার করে। একটি বৈষ্ণব গোস্বামী জাহ্নবা দেবী প্রতিষ্ঠিত অপরটি বীরভদ্র প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে পরিশেষে বলা যায়, শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মের প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ তাঁর জীবদ্দশায় গুরু তত্ত্বের তেমন কোনো গুরুত্ব দেখা না গেলেও পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর পর গুরুতত্ত্ব বৈষ্ণব মতের বা সাধনার একটি বিশেষ অঙ্গে পরিণত হয়। প্রধান প্রধান বৈষ্ণব গোস্বামী বা মহাভরা গুরুত্ব বা মঞ্জুরী প্রাপ্ত হন।এবং গুরুরূপে বৈষ্ণব সাধকদের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব পালন করেন।
বৈষ্ণব দর্শনের গুরুতত্ত্ব সম্পর্কে যা জান লিখ।
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079
Leave a Reply