বৈষ্ণব দর্শনের উৎস ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, বৈষ্ণব দর্শনের উৎস ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বৈষ্ণব দর্শনের উৎস ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, বৈষ্ণব দর্শনের উৎপত্তি ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বৈষ্ণব ধর্মমতের সার বা তত্ত্ব কথা নিয়েই গড়ে উঠেছে বৈষ্ণবদর্শন। বিষ্ণুর উপাসকরাই বৈষ্ণব। এ মতে, ঈশ্বরকে বিষ্ণু বা নারায়ণ, হরি বা কৃষ্ণ বলা হয়। তার নামই একমাত্র উপাস্য। বৈষ্ণব সমাজ বিষ্ণুর নাম সংকীর্তন ও নাম জপকে আধ্যাত্ম সাধনার প্রধান অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাদের এ সাধনা কর্ম বা জ্ঞানের উপর নয়, বরং প্রেমভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবই এ প্রেম দর্শনের প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা। বলা হয়।
বৈষ্ণববাদের মূলবীজ ঋগ্বেদে রোপিত হলেও শ্রীচৈতন্যের হাতেই তা ফুলে ফুলে সৌরভিত হয়ে উঠে। তাঁর প্রবর্তিত বৈষ্ণব দর্শনই বাঙালি দর্শনের ইতিহাসে প্রেমদর্শন নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে।
বৈষ্ণব দর্শনের উৎস ও গতিপ্রকৃতি : বৈষ্ণববাদের মূল কথা প্রেমভক্তি করুণা। বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠান শ্রীবিষ্ণুর নাম কীর্তন। বিষ্ণুর উপাসনা বিষয়ক সবচেয়ে প্রাচীন দলিল ঋগ্বেদ সংহিতা, গ্বদেই ব্যাখ্যাত বৈষ্ণব দর্শন ও দর্শনের মূল স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য। বাংলার প্রাচীন দার্শনিক ধারা প্রেমভক্তিবাদ হতে ষ্ণববাদের মূলসুর গৃহীত হয়েছে। পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন শ্রীচৈতন্যের পূর্বেও বাংলায় বৈষ্ণববাদ প্রচলিত ছিল। পঞ্চম শতকে গুপ্ত রাজাদের আমলে এক প্রকার বিষ্ণু বা কৃষ্ণতত্ত্ব অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্টভাবে প্রচলিত ছিল। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ঠাকুর, চণ্ডিদাসের গানমালা জয়দেবের গীত গোবিন্দ ইত্যাদি গ্রন্থে ‘রাধাকৃষ্ণ’ তত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। গীতার যে প্রেমভক্তির মাধ্যমে মুক্তি লাভের প্রকৃষ্ট উপায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে তা পুষ্টতা লাভ করেছে নাম শতকের দার্শনিক শংকরাচার্যের ভাবশিষ্য দ্বাদশ
শতকের দার্শনিক শ্রীধরস্বামীর হাতে। চৈতন্যপূর্ব বাংলায় প্রচলিত আদি বৈষ্ণববাদের যে ক্ষীণ ধারা প্রচলিত ছিল তার সাথে শ্রীধরস্বামী চেয়েছিলেন শংকরাচার্যের অবতারবাদের জ্ঞানের সাথে ব্যক্তিগত ঈশ্বর প্রেমভক্তির সমন্বয়সাধন করতে। বাংলায় বৈষ্ণববাদ প্রসারের অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন মাধবেন্দ্রপুরী ও তাঁর যোগ্যশিষ্য ঈশ্বরপুরী এবং শ্রী অদ্বৈত । তাঁরা ছিলেন শ্রীধর স্বামীর মতো অনুভূতিপ্রবণ শংকর অনুসারী বৈষ্ণব। ঈশ্বরপুরী ছিলেন একজন বাঙালি, তাঁর হাতেই চৈতন্য দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন এবং ঈশ্বরপুরী চৈতন্যের প্রাথমিক ধর্মীয় আগ্রহকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেন। তবে বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনের ভিত্তি প্রথম রচনা করেছিলেন রামানুজ তাঁর বিশিষ্ট দ্বৈতবাদে। শংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদ ছিল জ্ঞানমুখী ও প্রেমভক্তি বিরোধী। এ নির্জলা অদ্বৈতবাদের প্রভাবে যে প্রেমভক্তিবাদ হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রাণশক্তি তাতেই নব প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন রামানুজ। আর এ মতই প্রেমধর্ম বা ভক্তিধর্মরূপে বাংলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে শ্রীচৈতন্যদেবের হাতে।বাংলায় বৈষ্ণব দর্শনের প্রবর্তক, প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্রীচৈতন্যদেব।এককথায় বলা হয় বৈষ্ণববাদের মূলবীজ ঋগ্বেদে রোপিত হলেও শ্রীচৈতন্যের হাতেই তা ফুলে ফুলে সুরভিত হয়ে উঠে। সংস্কৃত ভাষায় রচিত মাত্র আটটি শ্লোকের মাধ্যমে চৈতন্য প্রকাশ করেন তাঁর প্রেমদর্শনকে। আর তাঁর এ দর্শনেরই বিস্তৃত টীকা ভাষ্য রচনা করেন বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী। তাঁরা হলেন রূপ’, সনাতন রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট ও জীব গোস্বামী। তাছাড়াও চৈতন্যদেব তাঁর প্রেমাত্মক দর্শনকে প্রচার ও প্রসারে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সহযোগী হিসেবে পান অদ্বৈত আচার্য নিত্যানন্দ, হরিদাস, শ্রীবাস পণ্ডিত, মুকন্দদত্ত প্রমুখ বৈষ্ণব ভক্তকে।বাংলায় শ্রীচেতন্যদেবের বৈষ্ণববাদের বিকাশের পটভূমিকায় তৎকালীন সমাজ কাঠামোটি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।চৈতন্যপূর্ব বাংলায় ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উগ্রতা, উচ্চবর্ণের লোকদের ধর্মীয় প্রাধান্য, জাত ভেদ প্রথা, সংস্কৃতির অসমচর্চা ও অবস্থান। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদের উগ্রতা, তত্ত্বনির্ভর হিন্দুধর্মের কঠোরতা তথা প্রেম বিবর্জিত ধর্মীয় আচার যা হিন্দু ধর্মকে অনাকর্ষণীয় করে তুলেছিল। বৌদ্ধধর্মীয় প্রভাবের ক্রমক্ষয়িষ্ণুতার সুযোগে একদিকে যেমন বাংলায় ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসার ও প্রচার শুরু হয়, তেমনি হিন্দুধর্মের নিয়ম পাণ্ডিত্য ও শুষ্ক আচার সর্বস্ততার সুযোগে সমাজে দেখা দেয় সহজিয়া আচার, তান্ত্রিকতার আচরণে সংঘটিত হতে থাকে নানারকম অনাচার, অত্যাচার ও সামাজিক ব্যভিচার, এ সময় শুধু জ্ঞাননির্ভর ধর্মাচার নয় অনাবিল প্রেম ও ভক্তির সমন্বয়ে ধর্মীয় আহ্বান শুনতেই উদগ্রীব ছিল চিরবঞ্চিত, ক্লেশ পীড়িত বাঙালি জন, যার মধ্যে থাকবে না কোনো শোষণ, উচ্চ বর্ণের অহমিকা, জাতপাত ভেদ, বাংলার সমাজের এরূপ দৈন্য পরিস্থিতিতেই শ্রীচৈতন্যদেব যুক্তিতর্কের তথা জ্ঞানের পথ পরিহার করে সকল মানুষকে আহ্বান করলেন প্রেমের পথে, ভক্তির পথে, বৈষ্ণব মতের পথে। যার ফলে বৈষ্ণববাদ অতি দ্রুত স্থান করে নেয় চিরবঞ্চিত সাধারণ বাঙালির মনে এবং আরোহণ করে বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে।
উপসংহার : উপরোক্ত আলোচনার পরিসমাপ্তিতে বলা যায়, মধ্যযুগের বাঙালির ধর্ম ও মনন সাধনায় বৈষ্ণববাদ একটি প্রভাবশালী মতধারা। বৈষ্ণববাদের মূলজীব ঋগ্বেদে রোপিত হলেও বাংলায় শ্রীচৈতন্য দেবের হাতেই তা প্রবর্তিত,প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত হয়ে পূর্ণতার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করে। এ প্রেম দর্শনের মাধ্যমেই চৈতন্যদেব মধ্যযুগের বাংলায় এক নবজাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*