বেঙ্গল রেনেসাঁ কাকে বলে? বেঙ্গল রেঁনেসার মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।


অথবা, বেঙ্গল রেনেসাঁ কী? বেঙ্গল রেঁনেসার মুল বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধর।
অথবা, বেঙ্গল রেনেসাঁ বলতে কী বুঝ? বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।
অথবা; বেঙ্গল রেনেসাঁ কী? বেঙ্গল রেনেসাঁর কী কী প্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে?
অথবা, বেঙ্গল রেনেসাঁ কী? বেঙ্গল রেনেসাঁর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
রেনেসাঁ শব্দের অর্থ হলো নবজাগরণ। আর বেঙ্গল রেনেসাঁ বলতে বাঙালির নবজাগরণকে বুঝানো হয়। উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। এ সময় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক ধরনের ভাব বিপ্লবের সূচনা হয়। একেই বাঙালির নবজাগরণ বা বেঙ্গল রেনেসাঁ বলা হয়। তবে এখানে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো যে অর্থে ইউরোপীয় রেঁনেসাকে দেখা হয় সে অর্থে বেঙ্গল রেঁনেসাকে বিবেচনা করা উচিত হবে না। বরং বেঙ্গল রেঁনেসার মূলে ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের ধারণা। ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুসমাজের প্রচলিত বর্ণপ্রথা, সতীদাহ প্রথা, বাল্য বিবাহ, আন্তঃবর্ণ ঘৃণা প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাই ছিল বেঙ্গল রেঁনেসার মূল লক্ষ্য।
বেঙ্গল রেনেসাঁ : আমরা জানি রেনেসাঁ হলো নবজাগরণ। তবে রেনেসাঁ শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, আমার যে বর্তমান স্বকীয়তা, সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেগুলোকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে নতুন করে শুরু করা। দ্বিতীয়ত, আমার সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত সবকিছুকে পুরোপুরি বাদ না দিয়ে সেগুলোর সংস্কার সাধন এবং নতুন ধ্যান ধারণার সাথে সেগুলোকে সংযুক্ত করে একটি নতুন রূপ প্রদান করা। বেঙ্গল রেনেসাঁ বলতে দ্বিতীয়টিকেই বুঝানো হয়। কেননা বেঙ্গল রেনেসাঁ সংঘটিত হলেও বাঙালিরা তাদের পুরাতন ধ্যান ধারণাকে পুরোপুরি বাদ দেয়নি এবং সেগুলোর উন্নতি সাধন (Reformation) করেছেন। বেঙ্গল রেনেসাঁ সূচনা শুরু হয় পনেরো শতকে শ্রীচৈতন্যদেব ও তার পর্ষদদের (ভক্ত) হাত ধরে, তবে উনিশ শতকে রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে বেঙ্গল রেনেসাঁ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। বেঙ্গল রেনেসাঁ সম্পর্কে Wikipedia, the free encyclopedia-তে বলা হয়েছে।
“The Bengali renaissance or Simply Bengal renaissance was a cultural, social, intellectual and artistic movement in Bengal region of the Indian subcontinent during the period of British rule, from the nineteenth century to the early twentieth century. The Bengal renaissance can be said it have stared with Raja Ram mohan Roy and ended with Rabindranath Tagore.”
বেঙ্গল রেনেসাঁ বলতে অবিভক্ত বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণকে বুঝানো হয়। ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় জীবন ও বিশ্বাসের নানা বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠে এবং প্রশ্ন তুলতে শেখে। বলা হয়, এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার সমসাময়িক জীবনধারাকে বস্তুতান্ত্রিকভাবে সবিশেষ প্রভাবিত করে। বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক আন্দোলন নানা সংগঠন, সমাজ ও সমিতি গঠন, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, নতুন শৈলীর বাংলা সাহিত্যের আবির্ভাব, রাজনৈতিক চেতনা এবং আরো উদীয়মান অন্যান্য সামাজিক রাজনৈতিক বিষয় এক নবজাগরণই ইতিবাচক লক্ষ্য বলে যুক্তি দেখানো হয়। বেঙ্গল রেনেসাঁ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের মতে, বেঙ্গল রেনেসাঁর মূলে ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে নবার্জিত ইউরোপীয় জ্ঞান বিশেষ করে দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্য বেঙ্গল রেনেসাঁর পথকে সুগম করে। ১৮৩৫ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষের সরকারি ভাষা হিসেবে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি চালু করলে বেঙ্গল রেনেসাঁর পথ সহজ হয়ে যায়। সুতরাং মূল কথা হলো পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে অবিভক্ত বাংলার জনগণের জীবন প্রণালিতে যে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সূচিত হয় তাকেই বেঙ্গল রেনেসাঁ বলে। তবে বেঙ্গল রেনেসাঁ কারো একার প্রচেষ্টায় সংঘটিত হয়নি। এর পেছনে কিছু ব্যক্তির অবদান অপরিসীম। তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শ্রী অরবিন্দ, রামকৃষ্ণ পরমহংস, উইলিয়াম কেরি, ডিরোজিও, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কেশবচন্দ্র সেন, দ্বারকানাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। এর পাশাপাশি ১৭৭৬ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব বাংলার নবজাগরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল ।
বেঙ্গল রেনেসাঁর মূল বৈশিষ্ট্য : ইতালিতে প্রথম রেনেসাঁর সূচনা হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের মধ্যদিয়ে তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়। এরই হাত ধরে উনবিংশ শতাব্দীতে এ ইংরেজ শাসনামলেই অবিভক্ত বাংলায় বেঙ্গল রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটে। বেঙ্গল রেনেসাঁ সৃষ্টির পেছনে ইউরোপীয় রেনেসাঁ এজন্য বিশেষভাবে দায়ী। ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রভাবে বেঙ্গল রেনেসাঁ সংঘটিত হলেও বেঙ্গল রেনেসাঁ তার স্বতন্ত্রতা হারায়নি। নিচে বেঙ্গল রেনেসার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ : বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর ফলে এদেশের জনগণের মধ্যে পাশ্চাত্য বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ বেড়ে যায়। পূর্বে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ইংরেজি শিক্ষার চর্চা করতো। কিন্তু পরবর্তীতে মুসলমান সম্প্রদায়ও নিজেদের অবস্থানকে টিকিয়ে রাখার মানসে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের উপর জোর দেন। সৈয়দ আমীর আলী, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়। ফলে মুসলমানরাও তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়।
২. সংস্কারের উপর গুরুত্ব আরোপ : বেঙ্গল রেনেসাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এ নবজাগরণের ফলে অবিভক্ত বাংলায় নানাবিধ সংস্কার কার্যক্রম সংঘটিত হয়। যেমন : রাজা রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিংক কর্তৃক হিমাজের প্রচলিত সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হয়। ১৮৫৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ইংরেজদের স য়তায় হিন্দু বিধবাবিবাহ চালু করেন। এর পাশাপাশি মুসলিম সমাজের নানাবিধ কুসংস্কার দূর করতে শুরু করে।
৩. স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধকরণ : বেঙ্গল রেনেসাঁ বাঙালিদেরকে স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাঙালিরা নিজেদেরকে একটি ঐতিহ্যবাহী জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে। বাংলাভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেড়ে যায়।
৪. মর্ত্যপ্রীতি, জিজ্ঞাসা ও সন্ধিৎসার প্রসার : বেঙ্গল রেনেসাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এর ফলে অবিভক্ত বাংলার জনগণের মধ্যে মর্ত্যপ্রীতি, জিজ্ঞাসা ও সন্ধিৎসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। শিক্ষিত সম্প্রদায় বিভিন্ন ধরনের বইপত্র ব্যাপকভাবে চর্চা করার সুযোগ পায়।
৫. স্বধর্মীয় স্বার্থ চেতনার বিকাশ : বেঙ্গল রেনেসাঁর ফলে হিন্দু ও মুসলিম সমাজে স্বধর্মীয় স্বার্থ চেতনার বিকাশ ঘটে। হিন্দু ও মুসলিম সমাজ উভয়েই নিজেদেরকে পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে।
৬. সংস্কৃতি তথা শিল্প সাহিত্যের বিকাশ : বেঙ্গল রেনেসাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি বাংলার তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। ফলে সংস্কৃতি তথা শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটতে থাকে। কলকাতা ও ঢাকায় বিভিন্ন শিল্পকারখানা, থিয়েটার, যাত্রা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
৭. সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের পরিবর্তন : বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রভাবে অবিভক্ত বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়। পরলোকমুখী ধ্যানধারণার পরিবর্তে বাস্তববাদী ধ্যানধারণার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ফলে সমাজে যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারার বিকাশ সূচিত হয়।
৮. শিক্ষার ব্যাপক প্রসার : বেঙ্গল রেনেসাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর মাধ্যমে বাংলায় শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক ১৫৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ।
৯. ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার উদ্ভব : বেঙ্গল রেনেসাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এর প্রভাবে সমাজে ধীরে ধীরে ধর্মীয় প্রভাব কমতে থাকে এবং তার স্থলে ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার উদ্ভব হয়। ধর্মের জন্য মানুষ নয়, বরং মানুষের জন্যই ধর্ম এ ধারণা শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
১০. সাহিত্যের বিকাশ : বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রভাবে, বাংলার সমাজে এক শ্রেণির সাহিত্যের আবির্ভাব ঘটে। যারা সাহিত্য চর্চায় নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত এদের মধ্যে অন্যতম।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, বেঙ্গল রেনেসাঁ বাঙালি সমাজের গতিধারাকে পুরোপুরি বদলে দিতে সক্ষম না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ধারা সূচিত করে। সমাজে কুসংস্কার, অনাচার, গোঁড়ামী, দূর হতে শুরু করে। হিন্দু সমাজের বিষফোঁড়া হিসেবে পরিচিত বহুবিবাহ, সতীদাহ, প্রথার বিলোপ ঘটে এবং বিধবা বিবাহের প্রচলন হয়। সুতরাং বলা যায়, বেঙ্গল রেনেসাঁ বাঙালি সমাজের এক অনন্য ও অসাধারণ ঘটনা। বর্তমান আধুনিক বাঙালি সমাজ অনেকাংশে বেঙ্গল রেনেসাঁর নিকট ঋণী।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b6-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%82-%e0%a6%ac%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*