বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁইমাচা’ গল্প অবলম্বনে ‘ক্ষেন্তি’ চরিত্র আলোচনা কর। বৈশিষ্ট্যসমত নিজের ভাষায় লিখ।

অথবা, ক্ষেন্তি কে? ক্ষেন্তির চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিজের ভাষায় লিখ।
অথবা, “ক্ষেন্তি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অনন্য সৃষ্টি”– এই উক্তির আলোকে ক্ষেন্তি চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
অথবা, “ক্ষেন্তি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি”— এই উক্তির আলোকে ক্ষেন্তি চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ লিখ।
অথবা, ‘পুঁইমাচা’ গল্পের ক্ষেন্তি গ্রামবাংলার এক নিগৃহীত নারী চরিত্র। এই উক্তির আলোকে ক্ষেন্তি চরিত্র প্রশ্ন কর।
অথবা, ক্ষেন্তি চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
‘পুঁইমাঁচা’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প। গল্পটিতে গল্পকার নিম্নবিত্ত বাঙালির অভাব-অনটনে জর্জরিত পরিবারের সহজ সুন্দর চিত্রটি তুলে ধরেছেন। দরিদ্র ব্রাহ্মণ সহায়হরি চাটুয্যের সংসার জীবনকে তুলে ধরতে গিয়ে বিভূতিভূষণ ক্ষেন্তি নাম্নী একটি অরক্ষণীয়া মেয়ের মর্মস্পর্শী কাহিনি বর্ণনা করেছেন। ক্ষেন্তি ‘পুঁইমাঁচা’ গল্পের প্রাণ। তাকে কেন্দ্র করেই এই গল্পের কাহিনি গড়ে উঠেছে।
কে এই ক্ষেন্তি : ক্ষেন্তি দরিদ্র ব্রাহ্মণ সহায়হরি চাটুয্যের প্রথমা কন্যা। চার বোনের মধ্যে ক্ষেন্তি সকলের বড়। তার বয়স চৌদ্দ-পনেরো বছরের মতো। তৎকালীন হিন্দু সমাজের প্রচলিত প্রথা অনুসারে ক্ষেন্তির বিয়ের বয়স পার হতে চলেছে। সে অরক্ষণীয়া। তাকে বিয়ে দিতে না পারলে তার পিতামাতাকে একঘরে হতে হবে। অথচ ক্ষেন্তির শিশুসুলভ আচরণ এখনো বর্তমান। বোনদের সাথে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো তার অভ্যাস।
পিতৃ অনুগত ক্ষেন্তি : অরক্ষণীয়া ক্ষেন্তি ছিল তার পিতা সহায়হরি চাটুয্যের একান্ত অনুগত ও বাধ্য। পিতাকে সে যেমন ভালোবাসত তেমনি মান্য করতো। এ কারণে বরাবরই সে পিতার কাছ থেকে সকল প্রকার প্রশ্রয় পেয়েছে। বরজপোতার জঙ্গল থেকে মেটে আলু চুরি করে আনার প্রস্তাবে ক্ষেন্তি বিনা ওজরে পিতার অনুগামী হয়েছে। কাজটা যে কতখানি গর্হিত তা বিচার করার প্রয়োজনীয়তা তার কাছে ছিল একান্তই গৌণ। এভাবেই ক্ষেন্তি তার পিতার প্রতি সর্বক্ষেত্রে আনুগত্য প্রদর্শন করেছে।
পুঁইভক্ত ক্ষেন্তি : ক্ষেন্তি পুঁইশাক খেতে ভালোবাসত। একবার অরন্ধনের আগের দিন তার মা পুঁইশাক রান্না করলে ক্ষেন্তি সেই শাকের অর্ধেকটা একা খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। রায়দের ফেলে দেয়া পাকা পুঁইশাকের ডাঁটা সংগ্রহ করে রেঁধে খাওয়ার
জন্য ক্ষেন্তি বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। এর জন্য মা অন্নপূর্ণা তাকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেছিল। পরে সেই শাকেরই কিছু অংশ রান্না হলে ক্ষেন্তি গভীর আগ্রহে তা গলাধঃকরণ করেছিল। আরও একটু দেবে কি না, মায়ের এই প্রস্তাবে ক্ষেন্তি প্রবল উৎসাহে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। ইচ্ছামতো পুঁইশাক খাওয়ার উদ্দেশ্যে সে বাড়ির পাঁচিলের পাশে পুঁইমাচা বেঁধে পুঁইচারা লাগিয়েছিল। কিন্তু
হতভাগিনী ক্ষেন্তি সেই শাক বেড়ে ওঠার আগেই অকালমৃত্যুকে বরণ করেছিল।
ভোজনপটু ক্ষেন্তি : ক্ষেন্তি খেতে খুব ভালোবাসত এবং বরাবরই বেশি পরিমাণে খেত। খাওয়ার ব্যাপারে তার কোন লাজ-
লজ্জার বালাই ছিল না। পিতা সহায়হরি ও মা অন্নপূর্ণা তার এই ভোজনপটুতাকে সবসময়ই প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখেছেন। ক্ষেন্তি পুঁইশাক ও পিঠে খেতে পছন্দ করত। বাড়িতে পুঁইশাক রান্না হলে এবং পিঠে বানানো হলে খুশিতে তার চোখ ছলছল করত। সে একবারে আঠারো- উনিশটা পিঠে খেতে পারত। কোন প্রকার সংকোচ না করে ক্ষেন্তি মার কাছ থেকে নারকেল কোরা চেয়ে নিয়ে গোগ্রাসে গিলত ।
নিরীহ প্রকৃতির ক্ষেন্তি : ‘পুঁইমাচা’ গল্পের সহায়হরি চাটুয্যের বড় মেয়ে ক্ষেন্তি ছিল নিরীহ প্রকৃতির। তার স্বভাব ছিল গোবেচারা ধরনের। তাকে হাজারো গালাগাল ও রাগরাগি করলেও সে এর প্রতিবাদ করত না। রায়েদের ফেলে দেওয়া পুঁইশাক তুলে আনার কারণে মা অন্নপূর্ণা তাকে যখন বকাঝকা করেন তখন ক্ষেন্তি ভারবাহী গর্ধভের মত চুপচাপ থেকেছে। আবার বাপের সাথে বরজপোতার জঙ্গল থেকে আলু চুরি করে আনার অপরাধে মা যখন তাকে ভর্ৎসনা করেছেন তখনও সে টু-শব্দ করেনি। সংসারের অভাব অনটনের প্রভাব ক্ষেন্তির উপরও পড়েছিল। তাই তো সংসারের কাছে তার কোন দাবি ছিল না। নিরীহ প্রকৃতির কারণেই বিনা চিকিৎসায় শ্বশুর বাড়ির অবহেলায় ক্ষেন্তিকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
সত্যবাদী ক্ষেন্তি : ক্ষেন্তি ছিল সত্যবাদী মেয়ে। সে কখনও মিথ্যা কথা বলত না। আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও ক্ষেন্তি মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি। বরজপোতার জঙ্গল থেকে চুরি করে আনা মেটে আলু সম্পর্কে সহায়হরি অন্নপূর্ণার কাছে মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যবাদী ক্ষেন্তি মায়ের প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যা বলতে পারেনি। সে নির্দ্বিধায় মা অন্নপূর্ণার কাছে সত্য প্রকাশ করেছিল।
লক্ষ্মীমন্ত ক্ষেন্তি : ক্ষেন্তি ছিল লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। অন্যায় পেয়ে মা তাকে বকাবকি করলে সে টু শব্দটিও করত না। এ কারণ অন্নপূর্ণার ধারণা ছিল- “ক্ষেন্তি আমার যার ঘরে যাবে, তাদের অনেক সুখ দেবে। এমন ভালো মানুষ কাজকর্মে বকো, মারো, গাল দাও, টু শব্দটি মুখে নেই । উঁচু কথা কখনও কেউ শোনেনি।”
দুর্ভাগিনী ক্ষেন্তি : জন্মই ছিল ক্ষেন্তির যেন আজন্ম পাপ। সে ছিল এক হতভাগিনী ব্রাহ্মণকন্যা। প্রথম যখন তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল তখন আশীর্বাদ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। একারণে পাড়ার মানুষ তাকে উচ্ছৃগু করা মেয়ে বলে অভিহিত করতো। অনন্যোপায় হয়ে সহায়হরি চল্লিশোর্ধ্ব পাত্রের সাথে ক্ষেন্তির বিয়ে দিয়েছিলেন। পণের টাকা বাকি থাকার কারণে ক্ষেন্তিকে আর বাপের বাড়িতে আসতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে হতভাগিনী ক্ষেন্তি বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। অনেক আশা করে বাড়িতে মাচা তে মাচা বেঁধে ক্ষেন্তি যে পুঁইচারা লাগিয়েছিল তা আর সে খেয়ে যেতে পারেনি। তার মৃত্যুর পর পুঁইমাচাটা ভরে উঠেছিল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ‘ক্ষেন্তি’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অনন্য সৃষ্টি। জনম দুঃখিনী এই মেয়েটির সাথে ‘পথের পাঁচালীর’ দুর্গার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ক্ষেন্তি দুঃখকে সাথী করে পৃথিবীতে এসেছিল এবং দুঃখকে সাথী করেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিল ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%81%e0%a6%87%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9a%e0%a6%be-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%b7/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*