বিভিন্ন ধর্ম কিভাবে বাঙালি দর্শনকে প্রভাবিত করেছে। আলোচনা কর।

অথবা, বাঙালি দর্শনের উপর বিভিন্ন ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শন কিভাবে বিভিন্ন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে সে সম্পর্কে যা জানো লেখ।
অথবা, “বাঙালি দর্শন বিভিন্ন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত” উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বাঙালির দর্শনচিন্তার ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি বিজাতি ও বিদেশি শাসন কর্তৃক শাসিত হলেও নিজস্ব মননসাধনার ব্যাপারে সে সব সময়ই ছিল স্বতন্ত্র। বাঙালি দর্শনে বিভিন্ন ধর্মের চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রত্যেক ধর্মের চিন্তাধারার সাথে নিজস্ব চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে বাঙালি তার নিজস্ব দর্শন গড়ে তুলেছে। তাই বাঙালি দর্শনে অন্যান্য ধর্মের প্রভাব অনস্বীকার্য। বাঙালি দর্শনে প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মের মধ্যে সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও ইসলাম ধর্মই উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বৈষ্ণব ধর্ম, শৈব ধর্ম, শাক্ত ধর্ম, সহজিয়া ধর্ম প্রভৃতি মতবাদ থেকে সৃষ্ট ধর্মের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে।
বাঙালি দর্শনের উপর বিভিন্ন ধর্মের প্রভাব : বাঙালি জাতি একটি সংকর জাতি। বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে। বাঙালির চিন্তার জগতেও সমন্বয়ের প্রমাণ মেলে। প্রত্যেক জাতির ধর্ম দ্বারাও বাঙালির দর্শনচিন্তা প্রভাবিত হয়েছে। যেমন- আর্য ও অনার্য চিন্তার সমন্বয়, আর্য চিন্তার সাথে বৌদ্ধ ও জৈন চিন্তার সমন্বয়, হিন্দু ও বৌদ্ধ চিন্তার সাথে ইসলামি চিন্তাচেতনার সমন্বয় হয়েছে। এ সকল জাতিগোষ্ঠী একত্রে মিলিত হয়েই বাঙালি নামে পরিচিত হয়েছে। তাই বাঙালি দর্শন প্রত্যেক জাতির ধর্মীয় চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
বাঙালি দর্শনে হিন্দুধর্মের প্রভাব : সনাতন ধর্ম বা হিন্দুধর্ম দ্বারা বাঙালির দর্শন সর্বাধিক প্রভাবিত। প্রাচীনকাল থেকেই আর্য সংস্কৃতির বাহক বেদকে কেন্দ্র করে যাবতীয় ধর্মীয়, দার্শনিক তথ্য সার্বিক আলোচনা পর্যালোচনা করা হয়েছে। সনাতন ধর্মে বেদই মূল ধর্মগ্রন্থ। মূলত বেদের দার্শনিক আলোচনাকে বাদ দিলে বাঙালি দর্শনের তেমন কোন প্রামাণ্য গ্রন্থ থাকে না। সনাতন ধর্ম খ্যাত হিন্দুধর্মের অনুসারী সাধকগণ মানুষের স্বরূপ, সংজ্ঞা, উৎপত্তি, পরিণতি, জগতে মানুষের স্থান, বেঁচে থাকার সার্থকতা প্রভৃতি দার্শনিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এদের মধ্যে বাঙালি অবাঙালি উভয় জাতি রয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, মনুসংহিতা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পুরাণ প্রভৃতির তত্ত্বালোচনাকে কেন্দ্র করে বাঙালি দর্শনের ভিত্তি গড়ে উঠে। বাঙালি দার্শনিকগণ হিন্দুধর্মের আলোকে প্রাচীন ও মধ্যযুগে কর্মবাদ, ভক্তিবাদ, মোক্ষ বা মুক্তি প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। এসব গ্রন্থে মানুষের পাশাপাশি ঈশ্বর ও জগতের স্বরূপ, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, জীবনের চরম পরিণতি বা লক্ষ্য প্রভৃতি বিষয়ের ব্যাখ্যা রয়েছে। বেদের দার্শনিক আলোচনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে ষড়দর্শনের। উপনিষদের বিভিন্ন খণ্ডে মানুষকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাঙালি দর্শনের প্রাচীন যুগ বলতে মূলত হিন্দুধর্ম দ্বারা প্রভাবিত দর্শনকেই নির্দেশ করা হয়।
জৈন ধর্ম : জৈন ধর্ম বেদ বিরোধী নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী ধর্ম। মহাবীরসহ ২৩ জন তীর্থঙ্কর এ ধর্মের প্রবর্তক। সর্বশেষ তীর্থঙ্কর হলেন ঋষভদেব। এ ধর্ম দ্বারাও বাঙালি দর্শন প্রভাবিত। জৈন ধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। এবং বেদের বিরোধিতা করা হয়। তারা কর্মবাদে বিশ্বাসী। তারা মানুষের মোক্ষ বা মুক্তিকে “কৈবল্য” বলে অভিহিত করেন। তীর্থঙ্করদের নির্দেশনা মেনে চললে কৈবল্য লাভ করা যায় বলে তারা প্রচার করেন। জৈন ধর্মে মানুষের মর্যাদা ও স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতবাদের সাথে তাদের অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। জৈন দর্শনে মানুষের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষের উৎপত্তি নিয়ে তীর্থদরগণ আলোচনা করেছেন। “জীব ও অজীব” সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। তারা জীবাত্মার চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করে দেহ থেকে পৃথক সত্তা হিসেবে দেখিয়েছেন। তারা ছিলেন অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী। তারা “স্যাবাদ” ধারণা নিয়ে আসেন যা সম্ভাব্যতা ও কার্যকারণ তত্ত্বের অনুরূপ। তারা যে দর্শন প্রচার করেন তা ছিল জীবনবাদী। বিশ্বমানবতাবাদ প্রচারে তাদের নীতিতত্ত্ব রাষ্ট্র দর্শনে তাদের অহিংসা নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে গান্ধীজি অহিংসা আন্দোলন গড়ে তোলেন। তারা মানবমুক্তির জন্য সম্যক বিশ্বাস সম্যক জ্ঞান ও সম্যক কর্ম নামক “ত্রিরত্নের” কথা প্রচার করেন। তাদের দর্শন প্রাচীন বাঙালি দর্শনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল।
বৌদ্ধধর্ম : বাঙালি দর্শন সহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্ম মানবতাবাদী চিন্তাধারার বিকাশে সর্বাধিক সফল দর্শন। বৌদ্ধধর্মের মূল তত্ত্ব নিয়েই বৌদ্ধদর্শন গঠিত। গৌতম বুদ্ধ এ ধর্মের প্রবর্তক। বৌদ্ধদর্শনে সকল প্রকার অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। তাই বৌদ্ধদর্শনকে নিরীশ্বরবাদী দর্শন বলা হয়। বৌদ্ধদর্শনের মূলভিত্তি হলো চারটি আর্য সত্য। এ আর্য সত্যকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধদর্শনের সামগ্রিক আলোচনা আবর্তিত হয়েছে। তিনি জগতে দুঃখের উপস্থিতি, দুঃখের কারণ, দুঃখ মুক্তির সম্ভাবনা ও পথ নিয়ে আলোচনা রেছেন। এ প্রসঙ্গে অষ্টাঙ্গিকমার্গ, পঞ্চমহাব্রত ধারণা প্রভৃতি আলোচনা করা হয়েছে। বৌদ্ধদর্শন অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী। মানুষের মুক্তি বা নির্বাণের জন্য পথ নির্দেশনা রয়েছে বৌদ্ধদর্শনে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৌদ্ধদর্শন সমৃদ্ধি লাভ করে। বহু বাঙালি দার্শনিক বৌদ্ধদর্শনের দার্শনিক বিষয়কে ব্যাখ্যা করেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি আচার্যগণ যে দর্শন চর্চা করেন তা ছিল বৌদ্ধদর্শনকেন্দ্রিক। বৌদ্ধদর্শনের যাবতীয় আলোচনা নির্বাণকে পরম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে অগ্রসর হয়েছে এবং মানবতাবাদের প্রচার করেছে।
ইসলাম ধর্ম : বাংলায় মুসলমানদের আগমনের পর বাঙালিদের উপর বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব হ্রাস পায়। শিক্ষা সংস্কৃতির সকল দিকেই তা ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করে। বাঙালি দর্শনচিন্তায় ইসলামি ভাবধারার সংমিশ্রণ শুরু হয় ত্রয়োদশ শতকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর। এর পূর্বে সুফিরা ইসলাম প্রচার করেন এবং তাদের চিন্তার সাথে বাঙালি দেশজ তন্ত্র, যোগ, দেহ সাধনা প্রভৃতির সংযোগ ঘটে। ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে। ফলে একজনের মধ্যে দুই ধরনের চিন্তার বিকাশ ঘটে। ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের আলোকে তারা সত্য অনুসন্ধানে ব্রতী হয়। এরই ধারাবাহিকতায় উনিশ শতকে বাংলায় রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটে। বাঙালি মুসলমানগণ জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার জন্য তথা মুক্ত বুদ্ধির চর্চার জন্য ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠা করে “মুসলিম সাহিত্য সমাজ।” পাশ্চাত্য প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বিচারবুদ্ধিকে অন্ধ শাস্ত্রানুগত্য থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য তারা গড়ে তোলেন বুদ্ধি মুক্তি আন্দোলন। এভাবেই বাঙালি দর্শনে ইসলামি আদর্শ বিশেষ স্থান দখল করে নেয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি, প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি দর্শনের বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রাথমিক স্তরে বৈদিক সাহিত্য ও সনাতন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে এবং এর পর পরই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে নতুন চিন্তাধারার সংযোগ ঘটায়। প্রাচীন যুগের শেষ এবং মধ্যযুগের শুরুর দিকে মুসলমান চিন্তাবিদদের দ্বারা বাঙালি দর্শনের নতুন ধারার সূচনা হয়। এদেশীয় চিন্তাভাবনার সাথে ইসলামি আদর্শের মিলন ঘটে। ফলে বাঙালি দর্শনে সুফিবাদ, বাউলবাদ, বৈষ্ণববাদ প্রভৃতি ভাবধারার ব্যাপক প্রসার হয়। তাই আমরা বলতে পারি, বাঙালি দর্শনের উপর ধর্ম বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে। ধর্ম ছাড়া বাঙালি দর্শনচিন্তা সম্ভব নয়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%a6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*